Facebook Bio Status

বৈষম্যই নারীমুক্তির প্রধান অন্তরায়


“এই তার স্বভাব! কী রহস্য ওদের চোখে -মুখে, ওরা চাঁদের মত মায়াবী, তারার মত সুদূর! ছায়াপথের মত রহস্য! শুধু আবছায়া শুধু গোপন”! জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথার মতো নারী স্বভাবসুলভ রহস্যময় হলেও এখন তারা আর আকাশের তারার মতো সুদূর নয়, তারা মায়াবী হলেও অন্ধকার আবছায়া নন। নারী এখন পুরুষের সমকাতারে সমভাবে সমুজ্জ্বল, তারা এখন গোপন নয়, প্রকাশ্য।

নারী দিবস কেবল একটি দিন উদযাপনের বিষয় নয়, এটি নারী অধিকার, সমতা এবং নারীদের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা যে অবদান রাখছেন, তা স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাদের প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার জন্য এই দিনটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

আমার দৃষ্টিতে, নারী দিবস শুধু আনুষ্ঠানিক আয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তব পরিবর্তনের সূচনা করা উচিত। নারীদের শিক্ষার সুযোগ, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নিশ্চিত করতে হলে শুধু একদিন নয়, প্রতিদিন নারীর মর্যাদাকে গুরুত্ব দিতে হবে।

আমার দৃষ্টিকোণ থেকে নারী দিবসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাওয়া হতে হবে ‘সমতা চাই, দয়া নয়’। অর্থাৎ নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করাই নারী দিবসের মূল লক্ষ্য। নারীদের জন্য করুণা বা দয়ার বদলে তাদের যোগ্য মর্যাদা ও অধিকার দেওয়া হোক।

‘অধিকার কেবল আইনে নয়, বাস্তবে চাই’। সংবিধান ও আইনে নারীদের অধিকার স্বীকৃত হলেও বাস্তবে অনেক নারী এখনো সেই সুবিধা পান না। বাস্তবায়নই আসল চ্যালেঞ্জ। যে দেশে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে মহিলা রাজনৈতিক নেতা ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে থাকেন, সেই দেশে শত শত নারী ও নারীশিশু ধর্ষণের খবর পড়ে সকাল শুরু হয়। কেমন করে, কীভাবে সম্ভব? আজো কেন নারীরা প্রান্তিকীকরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে? তাহলে কি এটাই প্রমাণ করে যে, ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলে নারীনেত্রীরা তাদের নিজস্ব গোষ্ঠীর বিশেষ দুরবস্থার কথা আর ভাবার সময় পান না! তাহলে নারীনেতৃত্ব কি এতদিন পুরুষ সংস্কৃতির প্রতিভূ হয়ে ছিল?

একটি শিক্ষিত, কর্মজীবী, স্বাবলম্বী তরুণী ব্যক্তিগত জীবনে সে কারো কন্যা, কারো প্রেমিকা, কারো স্ত্রী, কারো ভগিনী। পথ চলতে গিয়ে অথবা কর্মস্থলে কিংবা একা ঘরে বা জঙ্গলে যখন কোনো অবিবেচক, কামুক অথবা হিংস্র অপরাধীর দ্বারা ধর্ষিত হয়, তখন তার সমস্ত পরিচয় নিমেষে মুছে গিয়ে একটি পরিচয়ই বড় হয়ে ওঠে। আর সেটা হলো “নারী”। অন্যপক্ষে সেই মেয়েটি হতেও পারে অশিক্ষিত, গ্রাম্য অথবা শহুরে, হতে পারে সে গৃহবধূ বা অবিবাহিত বালিকা, কিছু যায়, আসে না তাতে। তার প্রতি সংঘটিত নির্যাতন, ধর্ষণের পরিবর্তে এসিড নিক্ষেপ, মারাত্মক মারধর অথবা শ্বাসরোধ করে হত্যাও হতে পারে যদি না কারও শারীরিক ক্ষুধা অথবা যৌতুকের লোভ মেটাতে সমর্থ হয় মেয়েটি৷ তখন তার আর কোনো পরিচয় থাকে না, সে শুধুই “নারী”।

সময় বদলাচ্ছে। নারীর কণ্ঠস্বর শোনার সময় এসেছে। নারীদের মতামত, চাহিদা ও অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। নীতি-নির্ধারণ থেকে পারিবারিক সিদ্ধান্ত— সব জায়গায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা জরুরি। নারীরা স্বাবলম্বী হলে পরিবার, সমাজ ও দেশ এগিয়ে যাবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে এবং কাজের ক্ষেত্রে নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষা ও সচেতনতা পরিবর্তনের চাবিকাঠি। নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। পরিবার থেকেই সমতার শিক্ষা দিতে হবে, যেন মেয়েরা নিজেকে দুর্বল না ভাবে এবং ছেলেরা নারীকে সহযোগী হিসেবে দেখে। নারীকে শুধুমাত্র মানুষ বানানোর মেশিন করে না রেখে নারীর প্রতি সহনশীল হতে হবে। নারীকে ইচ্ছেমতো ভোগ ও নারীদেহে অপ্রয়োজনীয় ও বিপজ্জনক অস্ত্রোপচার বন্ধ করা উচিত। গর্ভ যেহেতু নারীর, ঝুঁকি যেহেতু নারীদেহের, গর্ভপাত হবে নারীর সিদ্ধান্তে। পুরুষ ও প্রকৃতি যেন নারীর জন্য হুমকি বা প্রতিপক্ষ না হয়। বিজ্ঞান, গবেষণা, পুরস্কার ও বেতনকাঠামোতে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে হবে।

নারী শুধু কর্মজীবী বা গৃহিণী নন, তিনি একসঙ্গে মা, মেয়ে, বোন, কর্মী, উদ্যোক্তা, নীতিনির্ধারক, নানা ভূমিকায় সমাজের অগ্রগতিতে অবদান রাখছেন। তার প্রতিটি ভূমিকার মূল্যায়ন করা জরুরি। নারী অধিকার কেবল নারীর বিষয় নয়, এটি পুরো সমাজের। পুরুষদেরও বুঝতে হবে যে, নারীর ক্ষমতায়ন মানেই পুরুষের অধিকার কমে যাওয়া নয়, বরং একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ তৈরি হওয়া।

অসাম্প্রদায়িকতার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বুদ্ধিজীবী সমাজ তাদের বক্তৃতায়, লেখায়, শ্লোগানে কতগুলো শব্দের এবং বাক্যের পুনঃ পুনঃ ও জোরালো ব্যবহার আর সেইসব কার্যত বা ব্যবহারিক জীবনে কোনোকিছু প্রতিফলন না ঘটাবার কারণে এ সকল শব্দাবলী এতটাই গুরুত্ব ও ব্যঞ্জনা হারিয়েছে যে, আজকাল অনেক প্রগতিশীল লোকও গালভরা মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা শুনতে কেমন অস্বস্তিবোধ করেন। আসলে সাম্প্রদায়িক ও নারী প্রগতির কথা বলা অনেকটা আধুনিক যুগের সর্বশেষ পোশাক ও চুলের ফ্যাশনের মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমাদের দেশের কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও অন্য বুদ্ধিজীবীরা বক্তৃতা ছাড়া মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে যদি প্রকৃতই কিছু করে থাকেন তার প্রায় সবটাই সীমিত পর্যায়ের উঁচু পরিশীলিত সংস্কৃতির বিকাশে৷ যেমন: চারুকলায়, নৃত্যে, সঙ্গীতে, পোশাক এবং প্রসাধনে, উপস্থাপনায়, প্রদীপে, আল্পনায়, আনুষ্ঠানিকতায় আর তাদের প্রকাশিত রচনাসম্ভারে, পুস্তকে, ক্যাসেটে, রেডিও, টেলিভিশনে। কিন্তু ব্যবহারিক দিক দিয়ে এবং দৈনন্দিন জীবন চর্চায়, সার্বক্ষণিক জীবন যাপনে তার প্রতিফলন একেবারেই ঘটছে না৷

স্বীকার করি, কবি-লেখকরা সমাজ সংস্কারক নন৷ সমাজের অসামঞ্জস্য, বৈপরীত্য, সমস্যা ও অন্যায়গুলোই কেবল তারা তুলে ধরবেন, এর সমাধান আনবেন অন্যজনেরা, কিন্তু তারা কারা?

গার্হস্থ্য সহিংসতা, কর্মক্ষেত্রে হয়রানি, বাল্যবিবাহ, নারীর প্রতি সামাজিক কটূক্তি বন্ধ করতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীর নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী অবস্থানে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ালে সমাজের উন্নতি ত্বরান্বিত হবে।

বর্তমান যুগ প্রযুক্তিনির্ভর। কিন্তু এখনো প্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ কম। তথ্যপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স -এসব ক্ষেত্রে নারীদের উৎসাহিত করা জরুরি, যাতে তারা ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

নারী শুধু কর্মী নয়, তিনি মা। মাতৃত্ব যেন কর্মজীবনের বাধা না হয়, সেজন্য প্রসূতি-ছুটি, শিশুর জন্য ডে-কেয়ার সুবিধা, কর্মস্থলে সহায়ক নীতি গ্রহণ করা দরকার। শহরের তুলনায় গ্রামের নারীরা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ ও অর্থনৈতিক সুযোগ নিশ্চিত করতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।

গণমাধ্যমে নারীর ভূমিকা কেবল সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে নয়, বরং জ্ঞান, দক্ষতা ও নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি হিসেবে তুলে ধরতে হবে। সমাজের প্রচলিত নেতিবাচক ধারণাগুলো ভাঙতে হবে। বর্তমান নারীরা যদি বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যান, তবে পরবর্তী প্রজন্ম আরও শক্তিশালী হবে। তাই আজকের মেয়েদের সাহসী ও স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

আমাদের সমাজে নারীরা যখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খায়, এতে পুরুষ সমাজ নানারকম নেতিবাচক মন্তব্য করেন। কিন্তু সিগারেট বা ধূমপান নারী পুরুষ সকলের জন্য ক্ষতিকর। যখন খোলা রাস্তায় পুরুষ সিগারেট খায় তখন কখনও কোনো পুরুষ প্রতিবাদ করে কি? এতদিন শুধু নারীরাই ধূমপায়ী পুরুষদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছে। পুরুষ তাদের সমলিঙ্গের বিরুদ্ধে চুপ থেকেছে। যে প্রতিবাদ পুরুষ পুরুষের বেলায় করতে পারে না, সে প্রতিবাদ কেন শুধু নারীর বেলায়, এটা কি নারীর প্রতি বৈষম্য নয়?

এটি আসলে সমাজের দ্বৈত মানসিকতার একটি প্রকট উদাহরণ। ধূমপান স্বাস্থ্যকর নয়, তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই ক্ষতিকর। কিন্তু আমাদের সমাজে এটি পুরুষদের জন্য স্বাভাবিক একটি ব্যাপার হিসেবে গৃহীত হয়েছে, অথচ নারীরা করলে সেটিকে “অশোভন” বা “অগ্রহণযোগ্য” হিসেবে ধরা হয়।
আমাদের সমাজে এখনো অনেক কিছু পুরুষদের জন্য স্বাভাবিক এবং নারীদের জন্য নিষিদ্ধ বলে ধরা হয়। নারীরা যেন সবসময় “শালীন,” “সংযত” ও “বিনয়ী” থাকবেন এ বদ্ধমূল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। অনেক সমাজে নারীদের পোশাক, চলাফেরা, আচরণ- সবকিছু নির্দিষ্ট কিছু সীমার মধ্যে দেখতে চায়। ধূমপান যেহেতু বহুদিন ধরে পুরুষদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই যখন নারী তা করেন, তখন সমাজ সেটিকে “অস্বাভাবিক” মনে করে।

নারীদের জীবনযাত্রা ও সিদ্ধান্তের ওপর সমাজের নিয়ন্ত্রণ রাখার প্রবণতা রয়েছে। তারা কী পরবে, কোথায় যাবে, কীভাবে চলবে- এসব নিয়ে মন্তব্য করা যেন সমাজের “অধিকার” হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরুষরা খোলা রাস্তায় ধূমপান করলেও কেউ কিছু বলে না, কিন্তু নারী করলেই তা আলোচনা-সমালোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এটি সমাজের ভণ্ডামিরই একটি উদাহরণ।

বরং ধূমপানকে নির্দিষ্ট লিঙ্গের সঙ্গে সংযুক্ত না করে, এটি যে সকল মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সে দিকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নারী-পুরুষ উভয়কেই সমান চোখে দেখা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা দেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। সমাজকে বোঝাতে হবে যে, পুরুষ যা করলে স্বাভাবিক মনে হয়, নারী করলে তা অস্বাভাবিক হওয়ার কথা নয়।

সমালোচনা যদি করতেই হয়, তবে সেটি ধূমপানের ক্ষতি নিয়ে হওয়া উচিত, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য নিয়ে নয়। একটি আচরণ (যেমন: ধূমপান) যদি পুরুষের জন্য স্বাভাবিক হয়, তবে তা নারীর ক্ষেত্রেও একইভাবে বিবেচিত হওয়া উচিত। যদি ধূমপান খারাপ হয়, তবে তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে খারাপ; আর যদি তা গ্রহণযোগ্য হয়, তবে তা সবার জন্যই হওয়া উচিত। সমাজকে এই দ্বিচারিতা ত্যাগ করতে হবে।

প্রত্যেক মানুষের নিজের জীবনযাত্রা বেছে নেওয়ার অধিকার আছে। নারীদের সিদ্ধান্ত-তাদের পোশাক, চলাফেরা, পছন্দ-এসব নিয়ে সমাজের অন্যদের “মন্তব্য করার অধিকার” নেই। ব্যক্তি স্বাধীনতা শুধু পুরুষের জন্য নয়, নারীর জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত।

সংস্কৃতি পরিবর্তন হয় শিক্ষার মাধ্যমে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়াকে এমন বার্তা দিতে হবে যেখানে নারীকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে দেখা হয়, আলাদা কোনো “প্রকৃত নারী” বা “ভদ্র মেয়ে” টাইপের ছাঁচে ফেলে নয়।
এই বৈষম্য কমাতে হলে শুধু নারীরা সচেতন হলে হবে না, পুরুষদেরও বুঝতে হবে যে, তারা নিজেরাই দ্বৈত মানসিকতার শিকার। নারীর পোশাক, চলাফেরা বা ধূমপানের বিষয়ে অহেতুক মন্তব্য করা বা প্রতিক্রিয়া দেখানো আসলে তাদের নিজেদের মানসিক সংকীর্ণতাকেই প্রকাশ করে।

ফিল্ম, সিরিজ, বিজ্ঞাপন ও সামাজিক মাধ্যমে এখনো নারীদের আচরণ নিয়ে প্রচলিত ধাঁচের ধারণা প্রচার করা হয়। মিডিয়া যদি শক্তিশালী বার্তা দেয় যে, নারী-পুরুষ সমান এবং নারীর ব্যক্তিগত পছন্দ নিয়ে সমাজের এত মাথা ঘামানো উচিত নয়, তাহলে মানুষের মানসিকতা ধীরে ধীরে বদলাবে।

শৈশব থেকেই ছেলে-মেয়ে উভয়কে শেখাতে হবে যে, লিঙ্গভিত্তিক কোনো কাজ বা অভ্যাস নেই। “ছেলেরা কাঁদে না” বা “মেয়েদের এসব মানায় না”- এমন ধারণাগুলো ছোটবেলা থেকেই মুছে ফেলতে হবে। যখনই নারীর ওপর এই ধরনের অযৌক্তিক সমালোচনা হয়, তখনই সচেতন নাগরিকদের দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া, পাবলিক প্ল্যাটফর্ম-যেখানেই হোক, এই দ্বৈত নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে।

যদি ধূমপান ক্ষতিকর হয়, তবে তা রাস্তায় নিষিদ্ধ করা যেতে পারে, তবে সেটি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হতে হবে। এমন নিয়ম যেন না হয় যেখানে শুধু নারীদের জন্য বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

সংক্ষেপে, সমাজকে বুঝতে হবে যে, নারীর আচরণ নিয়ে অতিরিক্ত নজরদারি করা বন্ধ করতে হবে। তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দিতে হবে, আর সবকিছুকে “নারীর জন্য ঠিক না” বলে দাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বাদ দিতে হবে।

আসলে, সমাজ পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের উপর। ছোটবেলা থেকেই ছেলে-মেয়ে উভয়কে শেখাতে হবে যে, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য অযৌক্তিক। পাঠ্যপুস্তকে সমতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যেন নারীকে শুধু ত্যাগী মা বা গৃহিণী নয়, একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবেও উপস্থাপন করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লিঙ্গ-সমতা নিয়ে আলোচনা ও কর্মশালা আয়োজন করা জরুরি।

পরিবারই হলো শিশুদের প্রথম শিক্ষালয়। বাবা-মা যদি সন্তানদের সমতার শিক্ষা দেন, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরও ন্যায়সঙ্গত হবে। “মেয়েরা এটা করতে পারে না” বা “ছেলেরা কাঁদে না”, এই ধরনের বস্তাপচা চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

মানুষকে বোঝাতে হবে যে, একজন নারীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত: যেমন পোশাক, চলাফেরা বা ধূমপান নিয়ে সমাজের মাথা ঘামানোর দরকার নেই। নারীকে “শালীনতার” নির্দিষ্ট কাঠামোয় আটকে না রেখে, তার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে হবে।

পুরুষদেরও সচেতন হতে হবে যে, তারা নিজেরাই এক ধরনের সামাজিক চাপে থাকে, যেখানে তাদের শক্তিশালী হতে হয় বা নির্দিষ্ট আচরণ করতে হয়। বিজ্ঞাপন, সিনেমা, নাটক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীর ভূমিকা আরও বাস্তবসম্মত ও শক্তিশালীভাবে তুলে ধরতে হবে।

নারীদের সবসময় ভিকটিম বা নিছক সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে না দেখিয়ে, একজন স্বাধীন ও সক্ষম মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে ও জনপরিসরে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা ভয় বা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নিজেদের সীমাবদ্ধ না রাখেন।

যেকোনো বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। নারী বা পুরুষ যেই অন্যায় করুক, সেটি নিয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সচেতনতা তৈরি করা, প্যানেল আলোচনা করা ও বাস্তব জীবনে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো জরুরি। তবে সবকিছুর মূলেই রয়েছে শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

শুধু আইন বা আন্দোলন দিয়ে সমাজ পরিবর্তন করা কঠিন, যদি মানুষের মানসিকতা না বদলায়। আর মানসিকতার পরিবর্তন আসে শিক্ষা ও সচেতনতা থেকে। তাই, নারীর অধিকার ও সমতার জন্য সর্বোত্তম ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হলো সঠিক শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

যদি পরিবার, শিক্ষা ব্যবস্থা ও গণমাধ্যম একসঙ্গে সচেতনভাবে কাজ করে, তবে সমাজের এই বৈষম্যমূলক চিন্তাধারা পরিবর্তন করা সম্ভব।

লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/এমএস



Source link

Back to top button