গাজার পুনর্গঠন নিয়ে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া, যুদ্ধবিরতির ভবিষৎ অনিশ্চিত

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময় চুক্তির স্থবিরতার মাঝেই আরব নেতারা গাজা পুনর্গঠনের একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। তবে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে রয়েছে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ৷ প্রতিক্রিয়াও মিশ্র।
পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকার কর্মকর্তারা পাঁচ হাজার তিনশ কোটি ডলারের পাঁচ বছর মেয়াদি পুনর্গঠন পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন। মঙ্গলবার রাতে আরব লীগের এক বিশেষ সম্মেলনে এই প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।
কায়রোতে আরব লীগের মহাসচিব আহমেদ আবুল গেইতের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মুস্তাফা বলেন, গাজা ও পশ্চিম তীরকে একত্রিত করা এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংহতি গড়ে তোলার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তিনি আরও বলেন, সম্মেলনের চূড়ান্ত বিবৃতিতে ফিলিস্তিন সংকটের সব দিক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হবে, যাতে গাজার পুনর্গঠন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারে।
এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল মূলত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায়। ট্রাম্প গাজার ২৩ লাখ অধিবাসীকে স্থানান্তর করে সেখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বের নেতারা এই পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। জাতিসংঘও এই প্রস্তাবকে জাতিগত নির্মূলের সমতুল্য বলে অভিহিত করেছে।
হামাস কায়রোতে হওয়া বেশিরভাগ চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে, আমরা ফিলিস্তিনি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠনের জন্য সম্মেলনের আহ্বানকে স্বাগত জানাই। আমরা চাই, দ্রুত সময়ের মধ্যে সংসদীয় ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক, যাতে ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়।
তবে হামাস এখনো তাদের সামরিক অস্ত্র পরিত্যাগে রাজি হয়নি, যা পরিকল্পনার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
সম্মেলন চলাকালে ইসরায়েল ও হামাস যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর বিষয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। ১৯ জানুয়ারি শুরু হওয়া এই যুদ্ধবিরতিতে হামাস ২৫ জন বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে এবং আটজনের মরদেহ ফেরত পাঠিয়েছে। বদলে ইসরায়েল কয়েকশ ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি দিয়েছে।
তবে যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মখাইমার আবু সাদা বলেন, মূল প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে কীভাবে এই পরিকল্পনার পক্ষে রাজি করানো হবে? কারণ, মার্কিন সমর্থন ছাড়া এবং ইসরায়েলের অনাগ্রহের কারণে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
গাজা বর্তমানে ইসরায়েল ও মিশরের কঠোর অবরোধের মধ্যে রয়েছে। ২০০৭ সালে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই ইসরায়েল এই অবরোধ আরোপ করেছ। আরব লীগের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি বিশেষ ‘টেকনোক্র্যাাট’ কমিটি গাজার প্রশাসন পরিচালনা করবে, যা পরবর্তীতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে। জর্ডান ও মিশর গাজার পুলিশ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেবে। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হবে।
হামাস ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা বেসামরিক প্রশাসন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করতে পারে। গাজার আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু সাদা বলেন, হামাস বুঝতে পারছে, তারা আরব বিশ্বের সমর্থন হারিয়েছে এবং তাদের কাছে এখন মিশরের পরিকল্পনা গ্রহণ করা ছাড়া বিকল্প নেই।
তবে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল হামাসকে রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া ও তাদের অস্ত্র সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা। কিন্তু হামাস তাদের অস্ত্র ত্যাগ করতে রাজি নয়।
ইসরায়েল এই পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই পরিকল্পনাটি ৭ অক্টোবর, ২০২৩-এর পরবর্তী বাস্তবতাকে উপেক্ষা করছে এবং পুরনো ধারণার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে।
ইসরায়েল আরও বলছে, ট্রাম্পের প্রস্তাব গাজার জনগণের জন্য স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে। কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলো এই সুযোগ গ্রহণ না করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে।
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই হামাস বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে গাজা পরিচালনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং তারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ধারণাকেও প্রত্যাখ্যান করেছে।
ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ বলেছেন, ‘ইসরায়েলকে গাজার ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সেখানে বসতি স্থাপন করতে হবে।
তিনি আরও বলেছেন, তার দল যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ সমর্থন করবে না, যেখানে বাকি বন্দিদের মুক্তি এবং ইসরায়েলের পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের শর্ত রয়েছে।
গত রোববার ইসরায়েল গাজায় খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি ও অন্যান্য সহায়তা পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা আমাল রিফাই বলেন, আমি আশা করি পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের ঘর থাকবে, এবং গাজা আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। কিন্তু তারা যা বলছে, সবই কাগজে লেখা কথা। বাস্তব কাজ শুরু হলে তবেই আমরা বিশ্বাস করবো।
গাজার আরেক বাসিন্দা কামাল কেমাইল বলেন, মিশরের পরিকল্পনা গাজার ভবিষ্যতের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই, এটি কতটা সফলভাবে বাস্তবায়িত হবে। আমরা এখন দিশেহারা এবং যে-কোনো রকমের সাহায্যই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে
এমএসএম