Status

খাদ্য বরাদ্দ কমে যাওয়া রোহিঙ্গাদের উপরে যে প্রভাব ফেলবে

 

এ মাসের মধ্যে ১৫ মিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তা জোগাড় করতে না পারলে ১ এপ্রিল থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য খাবারের বরাদ্দ অর্ধেক কমানো হতে পারে। এমন পরিকল্পনা করছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি।

 

এর ফলে আগে প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে প্রতি মাসে মাথাপিছু যেখানে সাড়ে ১২ ডলারের খাদ্য সহায়তা দেয়া হতো, তা কমে দাঁড়াবে ছয় ডলারে। এতে করে প্রতি বেলার খাবারের জন্য বরাদ্দ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৬ টাকা থেকে কমে হবে আট টাকা। পরিণতিতে আগে থেকেই থাকা খাদ্য সংকট এবং অপুষ্টি আরও তীব্র আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

তবে এই খাদ্য সহায়তা কমানোর প্রভাব কেবল অপুষ্টিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং তা অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে বলেও সতর্ক করছেন বিশ্লেষকেরা।

 

খাদ্য সহায়তা কমানোর কারণ কী?

বাংলাদেশ সরকোরের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের বেশিরভাগই ২০১৭ সালে মিয়ানমারে সহিংসতার সময় পালিয়ে আসে।

 

গত বছরও প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

 

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি – ডব্লিউএফপি’র আওতায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এই রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়।

 

মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে অনুদান সংকটের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুদান কমে আসছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন ডব্লিউএফপি’র বাংলাদেশ মুখপাত্র কুন লি।

 

একই কথা জানিয়েছেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি থেকে পাঠানো চিঠিতে তহবিল সংকটের কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ কমানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানান মি. রহমান।

 

রোহিঙ্গাদের চাহিদা মেটাতে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ প্রয়োজন হবে ৮১ মিলিয়ন ডলার।

 

মিজ লি বলেন, বর্তমানে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতি মাসে ১৫ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হয়। কিন্তু এবার সেই তহবিল জোগাড় না হওয়ায় অর্থ সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

 

তবে এ মাসের মধ্যে ১৫ মিলিয়ন ডলারের তহবিল জোগাড় করা সম্ভব হলে, আগামী মাসেও একই হারে অর্থাৎ জনপ্রতি সাড়ে ১২ ডলার করে অনুদান দেয়া সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।

 

“দ্রুততম সময়ে ১৫ মিলিয়ন ডলার যোগাড় করতে না পারলে, রেশন কাট করতেই হবে”, বলেন কুন লি।

 

এর আগে, ২০২৩ সালে তহবিলের ঘাটতির কারণে রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু মাসিক খাদ্য সহায়তা ১২ মার্কিন ডলার থেকে কমিয়ে প্রথমে ১০ মার্কিন ডলার এবং পরে ৮ মার্কিন ডলারে করা হয়।

 

পরবর্তী সময়ে তা আবার বাড়ানো হয়।

 

ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে কমছে বরাদ্দ?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি’র তহবিল বন্ধের ঘোষণা দেন।

 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের কারণেই রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা তহবিল সংকটে পড়েছে কি না, এমন প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেননি ডব্লিউএফপি’র মুখপাত্র কুন লি।।

 

তবে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের মতে, বৈদেশিক সহায়তা কর্মসূচি স্থগিত করার কারণেও অনুদান কমতে পারে।

 

“আমরা এটা ধরে নিতে পারি, কারণ ফুড সেক্টরে (খাদ্য খাতে) যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অবদান ৮০ শতাংশের বেশি। সুতরাং ইউএস ফান্ডের যদি ডুয়েংলিং সিচুয়েশন (দোদুল্যমান অবস্থা) হয়, তার স্বাভাবিক একটা প্রভাব পড়বেই”, বলেন কুন লি।

 

রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা আগেও কমানো হয়েছে, আরও কমতে পারে ভবিষ্যতে। কেবল রোহিঙ্গাদের ওপরই না, এই প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশ সরকারের ওপরও।

 

এর আগে সমস্যা সমাধানে ২০২৪ সালের মার্চে বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে ‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান’ বা জেআরপির উদ্বোধন করা হলেও বছরটিতে কেবল ৭০ শতাংশ অনুদান পেয়েছে তারা।

 

ফলে পরিস্থিতিটাকে সরকার কীভাবে সামাল দিচ্ছে? এনিয়ে কথা বলতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

 

রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলী সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমানের কার্যালয় থেকে পাঠানো এক লিখিত বক্তব্য বলা হয়েছে, “বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমরা অবগত। আমরা দাতাদের সাথে কাজ করছি এবং দাতারাও এটি মোকাবেলার উপায় খুঁজে বের করার জন্য নিজেদের মধ্যে কাজ করছেন”।

 

সংকট মোকাবেলায় “সরকার টেকসই ও স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করার জন্য কাজ করছে” বলেও লিখিত বার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে।

 

বাড়বে খাদ্য সংকট ও অপুষ্টি

ডব্লিউএফপি’র এই বরাদ্দ পরিবার প্রধানের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের কাছে “সরাসরি ইলেক্ট্রনিক্যালি ট্রান্সফার হয়”।

 

এই খাদ্য সহায়তায় বরাদ্দ কমার ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর তীব্র প্রভাব পড়তে পারে বলেই মত সংশ্লিষ্টদের।

 

শুক্রবার কক্সবাজার সফরের সময় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ এক পোস্টে বলেন, যদি শিবিরগুলোয় দাতাদের সহায়তা “নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায় – যা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে – তাহলে বাংলাদেশ সরকার, সাহায্য সংস্থা ও শরণার্থীদের ওপর প্রভাব ফেলবে এবং এর ফলে হাজার হাজার মানুষ ক্ষুধা, রোগ এবং নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে পড়বে।”

 

মিজানুর রহমান বলছেন, “১২ দশমিক পাঁচ ডলার যেটি ছিল, তাতে প্রতি বেলা খাবারের দাম পড়তো বাংলাদেশি টাকায় ১৬ টাকা”।

 

“যখন একটি ডিমের দাম হয় ১৩-১৪ টাকা, কলার দাম হয় ১০-১২টাকা, সেটি কোনোভাবেই সাফিসিয়েন্ট (পর্যাপ্ত) ছিল না। এখন পয়লা এপ্রিল থেকে যখন এটি ছয় ডলারে নেমে যাবে, তখন হিসেব করে দেখা যাচ্ছে প্রতি বেলার খাবারের দাম পড়বে আট টাকা”, বলেন তিনি।

 

ফলে এমনিতেই খাদ্য সংকট আর তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই মনে করেন শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমানের । তিনি বলেন, বাড়তে পারে মাতৃমৃত্যু।

 

বিশেষ করে ঝুঁকিতে থাকা নারী ও শিশুদের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়তে পারে, যা কিনা মোট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৭৮ শতাংশ।

 

২০২৩ সালের উদাহরণ টেনে কুন লি বলেন, খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেয়ার ফলে সেসময় শরণার্থীদের উপর বিধ্বংসী প্রভাব পড়ে।

 

খাবার সংকট ও অপুষ্টি বেড়ে যাওয়া ছাড়াও এতে প্রভাবিত হয়েছিলেন নারীরা। এবারও তা ঘটতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে মিজ লি বলেন, “যেমনটি আমরা ২০২৩ সালে দেখেছি, বিশেষ করে নারী ও মেয়েরা শোষণ, পাচার এবং পারিবারিক সহিংসতার ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। শিশুদের স্কুল থেকে বের করে শিশুশ্রমে বাধ্য করা হতে পারে, মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হতে পারে।

 

“প্রভাব পড়বে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে”

খাবারের জন্য বরাদ্দ কমে গেলে এর সামাজিক প্রভাব থাকবে বলে মনে করেন আসিফ মুনীর। লম্বা সময় ধরে তিনি অভিবাসন ও রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছেন।

 

মি. মুনির বলেন, “যারা কাজ করে তাদের কাছ থেকে সবসময় শুনি যে অনেক সময় তারা বার্টার সিস্টেমে (বিনিময় প্রথা) যায় এবং ফুড রেশন থেকে যেটুকু উদ্বৃত্ত থেকে যায়, সেটার বিপরীতে মার্কেটে তারা দৈনন্দিন ব্যবহারের কিছু বার্টার করে”।

 

অন্য কোনো আয়ের উৎস না থাকায় তারা এমনটা করে।

 

“কিন্তু সেটা যদি কমে যায়, তাহলে অন্য কোনো মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করতে পারে এবং বেআইনী কোনো কাজও করতে পারে বা করতে বাধ্য হতে পারে”, বলেন তিনি।

 

এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘কিছুটা অবনতি হতে পারে’ এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তা ব্যবহার করতে পারে বলেও মন্তব্য করেন মি. মুনীর।

 

এছাড়াও বরাদ্দ কমলে ক্যাম্পের মধ্যে প্রতিবাদের মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে, যা আগেও দেখা গেছে।

 

খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেয়ার নেতিবাচক প্রভাব দেখা যেতে পারে রোহিঙ্গা শিবিরের বাইরেও। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সবচেয়ে বড় কথা এরাতো মানুষ, ইতর প্রাণী না যে খাঁচায় বন্দি করা যাবে। তারাতো ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবে। তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ স্থানীয় লোকজনের সাথে একটা সংকট তৈরি হতে পারে”।

 

এতে করে স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিষয়টিও সংকটে পড়তে পারে বলে মন্তব্য করেন মি. রহমান।

 

তবে জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানে রোহিঙ্গা ও হোস্ট কমিউনিটি অর্থাৎ স্থানীয়দের জন্য সহায়তা আলাদাভাবে ভাগ করা আছে। ফলে কেবল রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ কমানো হলে, ক্যাম্পের বাইরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হবার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছেন আসিফ মুনীর।

 

এছাড়া খাদ্য সহায়তা কমার প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের ওপর পড়বে না বলেও মনে করছেন মি. মুনীর।

 

তিনি বলেন, “সরকার, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সবাই মিলে সমন্বয় করছে এবং সেখানে হয়তো আলাপ-আলোচনার সুযোগ আছে। এনিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা অন্যান্য দেশের সঙ্গে সরকার আলোচনা চালাতে পারে।” সূত্র: বিবিসি বাংলা।

Source link

Leave a Reply

Back to top button