আতঙ্কের নাম মোটরসাইকেল

সারা দেশে লাখ লাখ মোটরসাইকেল রাস্তায় চলাচল করে। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত এসব মোটরসাইকেলের চালক মূলত উঠতি বয়সের কিশোরেরা। অতিরিক্ত মোটরসাইকেল ঢাকার রাস্তায় চলাচল করার কারণে প্রতিদিনের যানজট সৃষ্টি হয়। ছোট-বড় দুর্ঘটনা লেগেই থাকে। ঈদে গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে ঢাকা থেকে লাখ লাখ মানুষ মোটরবাইকে চড়ে বিভিন্ন জেলায় যান। আর এই সময়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় অনেকের।
রাজধানীর রাস্তায় মোটরসাইকেল চলাচল পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এদের অনেকেই মানেন না ট্রাফিক আইন, অনেকের নেই লাইসেন্স, অনেকের নামে মামলা দেয়া হলেও তারা মামলার জরিমানা দিচ্ছেন না। অনেকে হেলমেট ব্যবহার করেন না। যারা করেন সেটাও ভালো মানের হেলমেট না। রাজধানীতে এক দশক আগে এত মোটরসাইকেল না থাকলেও, ২০১৭ সালে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর থেকে অস্বাভাবিক হারে রাজধানীতে বেড়ে গেছে বাইকের সংখ্যা। অন্যান্য দেশে রাইড শেয়ারিং ধারণাটি ফুল টাইম চাকরি না হলেও, বাংলাদেশের সিংহভাগ মোটরসাইকেল চালক রাইড শেয়ারিং তাদের স্থায়ী পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এতে রাজধানীর বুকে প্রতিদিনই বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা।
সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাব বলছে, করোনাকালের পর ২০২২ সালে দেশে মোটরসাইকেল নিবন্ধনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। ২০২০ সালে দেশে মোট ৩ লাখ ১১ হাজার ১৬টি মোটরসাইকেল নিবন্ধন দেয়া হয়, যা ২০২১ সালে বেড়ে হয় ৩ লাখ ৭৫ হাজার ২৫২। পরের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে মোটরসাইকেল নিবন্ধন আরও বেড়ে হয় ৫ লাখ ৬ হাজার ৯১২। করোনাকালের পর অনেকেই চাকরি ফেরত না পেয়ে, অনেকে আবার ব্যবসায় লোকসানের শিকার হয়ে রাইড শেয়ারিংকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
ট্রাফিক পুলিশরা বলছেন, ট্রাফিক আইন না মানার দিক দিয়ে সবার আগে মোটরসাইকেল চালকরা। বিশেষ করে ফুটপাথ দিয়ে মোটরসাইকেল চালানো, ওভারটেকিং, অতিরিক্ত গতিতে মোটরসাইকেল চালানো এবং সিগন্যাল না মানা তাদের নিত্যদিনের ব্যাপার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, কিশোররা গভীর রাতে বেপরোয়া গতিতে ফুটপাথে তুলে দিলে বিকট শব্দ হয়। সংঘবদ্ধভাবে কিছু কিশোর বেপরোয়া গতিতে বাইক রেস করে। সব সময় আতঙ্কে থাকি, কখন কী হয়ে যায়। যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ঢাকায় পুলিশের নজরদারি বাড়ানো উচিত।
গবেষণায় উঠে এসেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তা বিশ্বে সর্বোচ্চ। দেশে দু’চাকার এ যানটির উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় দাম যেমন কমেছে, সহজে মিলছে নিবন্ধন, তেমনি পাল্লা দিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুও যেন সহজ হয়ে উঠেছে। লোনে, কিস্তিতে বা সামান্য টাকা হলেই মোটরসাইকেল কিনতে পারছে। কিন্তু তাতে যে মৃত্যুঝুঁকি কত বাড়ছে- সেটা যেন কেউ চিন্তা করছে না। সড়ক পথে বেপরোয়া গতিতে দাবড়িয়ে বেড়ানো মোটরসাইকেলগুলো এখন ভয়াবহ আতঙ্ক। দেশে অনিরাপদ সড়ক আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে পাল্লা দিয়ে মাঠে নামায় এই দু’চাকার যানটি। নিরাপদ সড়কের দাবিতে বাংলাদেশে রীতিমতো গণআন্দোলনের নজির থাকলেও সেই আন্দোলনের কোন সুফল পায়নি। সড়ক-মহাসড়কে এখনও মৃত্যুর মিছিল চলছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো মূলত ঘটে বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, বারবার লেন পরিবর্তন, ট্রাফিক আইন না মানা ও চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোনে কথা বলার কারণে। হেলমেট ব্যবহার না করা ও নিম্নমানের হেলমেটের কারণে দুর্ঘটনায় মৃেতর সংখ্যা বাড়ছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে ৫৯৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৭৮ জন নিহত এবং ১৩২৭ জন আহত হয়েছেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল শনিবার সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমানের সই করা প্রতিবেদনটি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২৪১টি দুর্ঘটনায় ২২৭ জন নিহত হয়েছেন। যা মোট নিহতের ৩৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। একই সময়ে ২টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৪ জন নিহত ও ২ জন আহত হয়েছেন এবং ১৪টি রেল দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত ও ৬ জন আহত হয়েছেন।
যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোটরসাইকেল-চালক ও আরোহী ২২৭ জন, বাসের যাত্রী ৩৩ জন, ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-ড্রাম ট্রাক আরোহী ৫৬ জন, প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস আরোহী ২২ জন, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা) যাত্রী ৯২ জন, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের (নসিমন-ভটভটি-মাহিন্দ্র-টমটম-এস্কেভেটর) যাত্রী ২০ জন এবং বাইসাইকেল-রিকশা আরোহী ১৪ জন নিহত হয়েছেন। ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ২০৫টি দুর্ঘটনায় ১৯৮ জন নিহত হয়েছেন আর বরিশাল বিভাগে সর্বনিম্ন ৩৪টি দুর্ঘটনায় ৩৪ জন নিহত হয়েছেন। একক জেলা হিসেবে ঢাকা জেলায় ৪১টি দুর্ঘটনায় ৪৮ জন নিহত হয়েছেন, আর মৌলভীবাজারে কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানি ঘটেনি। রাজধানী ঢাকায় ৩৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৭ জন নিহত এবং ৩৬ জন আহত হয়েছে।
প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহনের চলাচল, তরুণদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা ও উদাসীনতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএ’র সক্ষমতার অভাব এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি। দুর্ঘটনায় পুলিশ সদস্য ২ জন, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ১১ জন, সাংবাদিক ৪ জন, চিকিৎসক ২ জন, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ১ জন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ১ জন, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ১ জন বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা কর্মকর্তা ও কর্মচারী ৬ জন, বিভিন্ন এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ১১ জন, ঔষধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ২৩ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ২৯ জন,২ জন ইউপি মেম্বারসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ১৪ জন, বিদ্যুৎ মিস্ত্রি ২ জন, ইমাম-মুয়াজ্জিন ৫ জন, হাসপাতালের ক্লিনার ২ জন, পোশাক শ্রমিক ৬ জন, নির্মাণ শ্রমিক ১১ জন, রাজমিস্ত্রি ২ জন, প্রতিবন্ধী ৩ জন এবং দেশের বিভিন্ন স্কুল-মাদরাসা ও কলেজের ৬৭ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।
প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বাড়ানো, চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি, ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহনের জন্য আলাদা পার্শ্ব রাস্তা (সার্ভিস রোড) নির্মাণ, পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, রেল ও নৌপথ সংস্কার করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমানো, টেকসই পরিবহন কৌশল বাস্তবায়ন এবং ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ নিরবচ্ছিন্নভাবে কার্যকর করা।
গত জানুয়ারি মাসে ৬২১টি দুর্ঘটনায় ৬০৮ জন নিহত হয়েছিল। প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিল ১৯ দশমিক ৬১ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৯৬টি দুর্গটনায় নিহত হয়েছে ৫৭৮ জন। প্রতিদিন নিহত হয়েছে ২০ দশমিক ৬৪ জন। এই হিসেবে প্রাণহানি বাড়েছে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে অতিরিক্ত গতির কারণে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। এই গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারী এবং চালকদের মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ দরকার। যানবাহনের বেপরোয়া গতি এবং পথচারীদের অসচেতনতার কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে। এজন্য সরকারি উদ্যোগে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জীবনমুখি সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।