অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নই নারীর আসল ক্ষমতায়ন

দেশের অন্যান্য শিল্পের চেয়ে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাত কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নারীর ক্ষমতায়নে আলাদা। আমরা গ্রামের অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত এবং পিছিয়ে পড়া নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছি। ফলে আজ তারা অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং দারিদ্র্য থেকে মুক্তি লাভ করেছে। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নই নারীর আসল ক্ষমতায়ন, বলে জানিয়েছেন দেশ গার্মেন্টসের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক ভিদিয়া অমৃত খান।
বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষ্যে জাগো নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
ভিদিয়া অমৃত খান প্রয়াত নুরুল কাদের খানের মেয়ে, যিনি ১৯৭৭ সালে দেশের প্রথম শতভাগ-রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস দেশ গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করেন। ভিদিয়ার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের বিশেষ প্রতিনিধি ইব্রাহীম হুসাইন অভি।
জাগো নিউজ: নারীর ক্ষমতায়নে তৈরি পোশাকশিল্পের ভূমিকা?
ভিদিয়া অমৃত খান: চার দশক ধরে অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পোশাকশিল্প দেশের উন্নয়নে কাজ করছে। এই খাতটি শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, নারীদের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ শিল্পে কর্মসংস্থানের ফলে নারীরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করছে এবং নিজেদের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ পাচ্ছে।
কোনো ধরনের পিছুটান না রেখে নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে তৈরি পোশাকশিল্প। কোনো ধরনের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই একজন নারী তৈরি পোশাকশিল্পের কাজে অংশ নিতে পারেন। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পর সে যে কোনো সময় অবসরে যেতে পারেন। তাকে আটকে থাকতে হয় না।
জাগো নিউজ: তৈরি পোশাকশিল্পে কাজ করে কীভাবে একজন নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে?
ভিদিয়া অমৃত খান: নারীর মুক্তি এবং ক্ষমতায়নে প্রধান শর্ত আর্থিক সচ্ছলতা। নারীরা এ খাতে কাজ করে অনেক সুবিধা পাচ্ছেন। কর্মসংস্থানের ফলে সবচেয়ে বড় অর্জন আর্থিক স্বাধীনতা। গ্রামের অনেক নারী এখন পরিবারের আয়ের একটি বড় অংশ উপার্জন করছেন। ফলে পরিবারে তাদের অবস্থান আগের চেয়ে শক্ত। ফলে পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা প্রভাব ফেলতে পারেন। তারা নিজেদের সন্তানদের শিক্ষিত করতে পারছেন, পরিবারের স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করতে পারছেন এবং ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে পারছেন।
এ খাতে নারীরা নতুন দক্ষতা অর্জন করছেন যেমন সেলাই, কোয়ালিটি কন্ট্রোল এবং ব্যবস্থাপনা। এসব দক্ষতা তাদের আরও কর্মসংস্থানে সুযোগ এনে দেয়, যা তাদের ক্যারিয়ারের জন্য সহায়ক। এ ছাড়াও নারীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারছে, যা সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।
জাগো নিউজ: শিল্পের নারী শ্রমিকরা কতটা অধিকার ভোগ করে?
ভিদিয়া অমৃত খান: যদিও কিছু সমালোচনা রয়েছে বিশেষ করে কর্মপরিবেশ এবং শ্রমিক অধিকার নিয়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মালিক, বৈশ্বিক ক্রেতা, সরকার ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা যৌথভাবে কাজ করেছে। ফলে কারখানায় কর্মপরিবেশ উন্নত হয়েছে, শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে এবং ন্যায্য মজুরি দেয়া হচ্ছে।
শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, এবং শ্রমিক অধিকার বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। শ্রমিক কল্যাণের জন্য ফান্ড গঠন করা হয়েছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রদান, শিশু যত্ন কেন্দ্র এবং মেডিকেল সেন্টার রয়েছে কারখানাতে। শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আমরা কাজ করছি। ইতিমধ্যে একটি সচেতনতা তৈরি হয়েছে যে নারী ক্ষমতায়ন এবং সাসটেইনেবল (স্থিতিশীল) উন্নয়ন নিশ্চিত করতে, আমাদের কর্মপরিবেশ উন্নত করতে হবে।
জাগো নিউজ: ভবিষ্যতে নারী কর্মজীবীরা কি আরও বেশি নেতৃত্বে আসতে সক্ষম হবেন?
ভিদিয়া অমৃত খান: যদিও শুরুর দিকে আরএমজি খাতে নেতৃত্বের ভূমিকা মূলত পুরুষদের হাতেই ছিল, তবে এই ক্ষেত্রে বেশ পরিবর্তন এসেছে। এখন নারীর নেতৃত্বের সংখ্যা বেড়েছে। আমরা দেখছি যে অনেক নারী ফ্যাক্টরি সুপারভাইজার, ম্যানেজারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। কারখানার মালিকানায় নারীর সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এটি অত্যন্ত উৎসাহজনক। কারণ নারী নেতৃত্ব যে কোনো প্রতিষ্ঠানে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে। বিশেষভাবে, যখন নারী নেতৃত্বে আসে, তারা নারীদের সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জগুলো আরও ভালোভাবে বুঝতে পারেন এবং সেই অনুযায়ী নীতিমালা এবং পরিবেশ তৈরি করতে পারেন।
জাগো নিউজ: নেতৃত্বের শীর্ষে উঠতে আরও কি পদক্ষেপ প্রয়োজন?
ভিদিয়া অমৃত খান: কর্মে নারীর অংশগ্রহণ অত্যন্ত উৎসাহজনক। এ ধারা অব্যাহত রাখতে এবং টেকসই করতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, নারীদের নেতৃত্বের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং উন্নয়নমূলক কর্মসূচি চালু করতে হবে, যেমন ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, আর্থিক জ্ঞান এবং ব্যক্তিগত উন্নয়ন। নারীরা যাতে অভিজ্ঞদের কাছ থেকে সহায়তা এবং নির্দেশনা পেতে পারে সেজন্য একটি শক্তিশালী পরামর্শক বা মেন্টরশিপ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। লিঙ্গ সমতার প্রচারে আরও শক্তিশালী নীতি তৈরি করতে হবে যাতে পুরুষ এবং নারীর মধ্যে সমান সুযোগ থাকে এবং নারী শ্রমিকদের জন্য আরও সুরক্ষিত ও মর্যাদাপূর্ণ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে নারী ক্ষমতায়নের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
ভিদিয়া অমৃত খান: আমি একজন আশাবাদী মানুষ। আমার রক্তে মিশে আছে এ শিল্প। কারণ আমার বাবার হাতে রপ্তানিমুখি পোশাক শিল্পের জন্ম। এটি এমন একটি খাত যেখানে নারীরা শুধু কর্মী নন, বরং নেত্রী, উদ্যোক্তা এবং নারীর ক্ষমতায়নের সমর্থক হিসেবে আবির্ভূত হবে। আমি আশা করি, কর্মের মাধ্যমে নারীরা যখন আরও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পাবে, তখন তারা সামাজিক বাধাগুলো অতিক্রম করতে সক্ষম হবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে উঠবে। আরএমজি খাত বাংলাদেশের আরও সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে, যেখানে নারীরা সত্যিকার অর্থে নিজেদের সম্ভাবনা পূর্ণ করতে পারবে।
জাগো নিউজ: কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ টেকসই করতে আপনার সুপারিশ কী?
ভিদিয়া অমৃত খান: অর্থনীতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ টেকসই করতে হলে কাঠামোগত ও নীতিগত পরিবর্তন প্রয়োজন। কর্মস্থলে নারীর অধিকার সংরক্ষণে প্রচলিত আইন যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে। কর্মজীবী নারীদের হয়রানি প্রতিরোধ আইন কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নারীবান্ধব অবকাঠামো নিশ্চিতের পাশাপাশি বিশেষ করে রাতে কাজ করা নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবহণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
অন্যদিকে, মহিলাদের বিনিয়োগে আগ্রহী করতে নারীদের জন্য উদ্যোক্তা উন্নয়ন তহবিল গঠন করতে হবে। প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়াতে হবে। নারীদের প্রতি বিদ্যমান কুসংস্কার ও বৈষম্য দূর করতে শিক্ষা ও প্রচারণা চালানো দরকার। নারীদের নেতৃত্বের সুযোগ বাড়াতে হবে, বিশেষ করে ব্যবসা, প্রশাসন ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমতার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
আইএইচও/এমএমএআর/এএসএম