খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেয়ার খবরে উদ্বিগ্ন রোহিঙ্গারা, আইনশৃঙ্খলা অবনতির আশঙ্কায় স্থানীয়রা

দেশের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তায় খরচের পরিমাণ অর্ধেকের বেশি কমাচ্ছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। প্রতিমাসে একজন রোহিঙ্গা নাগরিকের জন্য দেয়া অনুদান ১২ দশমিক ৫০ ডলার থেকে কমিয়ে ৬ ডলার করা হয়েছে। যা কার্যকর হচ্ছে পহেলা এপ্রিল থেকে। এমন খবরে উদ্বিগ্ন রোহিঙ্গারা। বরাদ্দ কমানো হলে খাদ্য সংকটের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায়না।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। যার মধ্যে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ৫ হাজার ৫২০ জন। পরিবার রয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার ২৭৪টি। আশ্রিতদের মধ্যে ৫২ শতাংশ শিশু, ৪৪ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক এবং ৪ শতাংশ বয়স্ক রয়েছে। যার মধ্যে ৪৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৫১ শতাংশ নারী। আর প্রতিবছর
৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্মগ্রহণ করে। তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৭-৭৮ সালে ২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে, যার মধ্যে ১ লাখ ৯০ হাজার মিয়ানমারে ফিরে যায়।
এরপর ১৯৯১ সালে ২ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন অনুপ্রবেশ করে, যার মধ্যে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯
জন মিয়ানমারে ফিরে যায়। ২০১২ থেকে ১৬ সাল পর্যন্ত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে।
তারপর ২০১৭ সালে ৮ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। আর ২০২৪ সালে ৬৪ হাজার ৭১৮ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে।
মূলত বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা দিয়ে আসছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বা ডব্লিউএফপি। হঠাৎ ‘তহবিল ঘাটতির’ কারণ জানিয়ে সহায়তার পরিমাণ অর্ধেকের বেশি কমাচ্ছে সংস্থাটি। জনপ্রতি মাসিক খাবারের বরাদ্দ সাড়ে ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ৬ ডলারে নামিয়ে আনা হচ্ছে। যা কার্যকর হচ্ছে এপ্রিল মাস থেকে। এ নিয়ে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ উৎকন্ঠা।
উখিয়ার ৪ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা হোসেন জোহার (৪৫) বলেন, মিয়ানমারে অসহায় হয়ে বাংলাদেশে এসেছি। এখানে যা দিচ্ছে তা দিয়ে কোন রকম খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি। এখন এত বছর পর এসে যদি রেশন বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হলে আমরা কি খেয়ে বেঁচে থাকব।
একই ক্যাম্পে বাসিন্দা মোহাম্মদ ইদ্রিস (৫০) বলেন, এখন বরাদ্দের ১২ ডলার দিয়ে কোন রকম চলে যাচ্ছে। সামনের মাসে যদি বরাদ্দ কমিয়ে ৬ ডলার করে তাহলে খাদ্য সংকট বাড়বে। এতে করে ক্যাম্পে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবেনা তা বলা যাচ্ছেনা।
বর্ধিত ৪ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা সোনা মিয়া (৫৮) বলেন, ৬ ডলার খাদ্য সহায়তা দেয়া হলে ক্যাম্প মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। ছোট শিশুরাও বাদ যাবে না। তারপর ক্যাম্প অঘটন ঘটবে। পর্যাপ্ত খাবার না পেলে চুরি-ডাকাতি করবে, একজন আরেকজনকে মারবে।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের (৫৫) বলেন, পহেলা এপ্রিল থেকে রোহিঙ্গাদের জনপ্রতি ৬ ডলার করে খাদ্য সহায়তা পাবে। এতে বড় সমস্যা এ তৈরি হবে। কারণ একজন রোহিঙ্গা ৩ বেলা খাবার খায়। ৬ ডলার হিসেব করলে দিনে ২৩ টাকা করে পড়ে। আর একবেলা খাবারে পাচ্ছে মাত্র ৭টাকা। যখন রোহিঙ্গারা খেতে পাবে না তখন পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়বে এবং নানা ধরণের অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়বে। চুরি, ডাকাতি করবে, ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যাবে। তখন বিশ্ববাসী রোহিঙ্গারা খারাপ এটা বলবে। আমরা এটা চাই না।
এদিকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনগোষ্ঠী রয়েছে ৫ লাখের বেশি। স্থানীয়দের আশঙ্কা খাদ্য সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর এমনটায় শঙ্কা করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ফারুক আহমদ (৫০) বলেন, রোহিঙ্গারা খাদ্যের জন্য ক্যাম্পের বাইরে চলে আসবে। মানুষের ওপর অত্যাচার করবে। চুরি, – ডাকাতি, অপহরণ থেকে শুরু করে সব ধরণের অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাবে। ফলিয়ারপাড়ার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন (৪৫) বলেন, আমরা খুবই আতংকের মধ্যে রয়েছি। এখন যদি রোহিঙ্গাদের বরাদ্দ কমিয়ে দেয় তাহলে আমরা আরো বেশি সমস্যায় পড়ে যাব।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের অতিরিক্ত কমিশনার মো. সামছু-দ্দৌজা বলেন, খাদ্য সহায়তা কমলে রোহিঙ্গাদের পুষ্টি, স্বাস্থ্যে ঘাটতি হবে এবং ক্যাম্পের নিরাপত্তায় বিঘ্নিত হবে। রোহিঙ্গারা কাজের সন্ধানে ক্যাম্পের বাইরে চলে যেতে চাইলে সরাসরি প্রভাব পড়বে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি-ডব্লিউএফপি শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি বলেছে, অর্থায়নের অভাবে দেশের ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর খাদ্য সহায়তা হুমকির মুখে পড়েছে। জরুরি নতুন তহবিল পাওয়া না গেলে শরণার্থীদের মাসিক রেশন ১২.৫০ ডলার থেকে কমিয়ে ৬ ডলারে নামিয়ে আনতে হবে। আর এই সংকট এমন এক সময়ে আসছে, যখন শরণার্থীরা রমজান শেষে ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ও ডব্লিউএফপির রেশনের অংশ হিসেবে বর্তমানে রোহিঙ্গারা নির্ধারিত দোকান ব্রা থেকে ভাউচারের মাধ্যমে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার কিনতে পারে। তবে পূর্ণ রেশন চালিয়ে যেতে এপ্রিলে জরুরিভাবে ১৫ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৫ সালের শেষ পর্যন্ত মোট ৮১ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
যু বাংলাদেশে ডব্লিউএফপির কান্ট্রি ডিরেক্টর ডম স্ক্যালপেলি বলেন, “রোহিঙ্গা এই শরণার্থী সংকট বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও দীর্ঘস্থায়ী মানবিক সংকট। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা সম্পূর্ণভাবে মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। খাদ্য সহায়তা কমানো হলে তারা গভীর সংকটে পড়বে এবং বেঁচে থাকার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে।”
এই প্রেক্ষাপটে আগামী ১৩ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব… উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফর করছেন। রোহিঙ্গাদের সমস্যগুলো তিনি জানবেন, শুনবেন এবং তাদের আবাসভূমি মিয়ানামারের আরাকানে প্রত্যাবাসন বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে।