Status

স্থবির আবাসনখাত

রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে কয়েকটি সেক্টরের ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্দীপনা দেখা গেলেও বেহাল দশায় আবাসন ব্যবসায়ীরা। এ খাতে ব্যবসায়ী, ব্রোকার, শ্রমিক কেউ ভালো নেই। ব্যবসা মন্দা হওয়ায় সবার মধ্যে অনিশ্চয়তা। দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা আবাসন খাত বাংলাদেশে গত প্রায় ৩৫ বছর ধরে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জিডিপিতে ১৫ শতাংশ অবদান খাতটির। কর্মসংস্থানসহ দেশের অন্যান্য শিল্পখাতের বিকাশেও ভূমিকা রয়েছে আবাসন খাতের। এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিন শতাধিক ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ বা সহযোগী শিল্পও ভালো নেই। সব মিলিয়ে আবাসন শিল্পের ৪৫৮ উপখাত ঝুঁকিতে রয়েছে। সরাসরি অর্ধকোটি মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে এ শিল্পে। আর এই শিল্পের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রায় দুই কোটি মানুষ নির্ভরশীল। অথচ প্রায় দেড় দশক ধরে দেশের আবাসনখাতে মন্দা বিরাজ করছে। এ সময়ে গার্মেন্টস, জনশক্তি রফতানিসহ বাণিজ্য ও রেমিট্যান্স সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে প্রবৃদ্ধির উঠানামা ঘটলেও আবাসন খাতের স্থবিরতা কাটাতে কার্যত কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। আর তাই নানামুখী প্রতিবন্ধকতা গ্রাস করছে শিল্পটিকে। মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম এই খাতে এখন স্থবিরতা চরমে। প্লট, ফ্ল্যাট ও বাড়ি বিক্রিতে মন্দা। হচ্ছে না নতুন বিনিয়োগ। অনেক কোম্পানি পরিচালন খরচ মেটাতে লাভ না করেই প্লট ও ফ্ল্যাট ছেড়ে দিচ্ছে। অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো বেতন দিতে পারছে না কর্মীদের। এতে নতুন করে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের আবাসনখাত। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশের আবাসনখাতে চলছে ভয়াবহ অস্থিরতা। এর মূলে ড্যাপ বা নগর পরিকল্পনা নিয়ে অনিশ্চয়তা আবাসনখাতের স্থবিরতাকে প্রকট ও দীর্ঘস্থায়ী করেছে।

নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি ও নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) কারণে এক বছরের ব্যবধানে ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। নতুন ‘ড্যাপ’ বৈষম্যমূলক ও অস্পষ্ট হওয়ায় এর কারণে নতুন করে ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে না। মানুষ প্লট কিনছে না। ড্যাপ পুনর্বিবেচনা করা না হলে দাম আরো বাড়তে পারে বলে শঙ্কা আবাসনখাত সংশ্লিষ্টদের। ড্যাপে আতঙ্কিত ক্রেতারা টাকা হাতছাড়া করতে নারাজ। প্লট ও ফ্ল্যাটের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ। নেই টাকার সরবরাহ। এমন পরিস্থিতিতেও আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংক কোনো সহযোগিতা করছে না। অসংখ্য ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধের হুমকিতে পড়েছে। সব মিলিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। সূত্র মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে রাজধানীতে ছোট ও মাঝারি ফ্ল্যাটের বুকিং ও বিক্রি এক বছরের ব্যবধানে ২০ শতাংশ কমেছে। বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আবাসনখাতের উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি প্লট বা জমি বিক্রির পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।

আবাসন শিল্প মালিকদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) জানিয়েছে, দেশে সাম্প্রতিক সময়ে নির্মাণসামগ্রীর মূল্য অনেক বেড়েছে। প্লট আর ফ্ল্যাট বিক্রি এখন শূন্যের কোটায়। ক্রেতাদের কিস্তি পরিশোধও বন্ধ। নেই টাকার সরবরাহ। ফলে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। অনেক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার হুমকিতে পড়ায় ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। উদ্যোক্তারা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে আবাসন খাতে এক শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে ক্রেতাদের জন্য সেই ব্যবস্থা নেই। তাই চলমান এ সঙ্কট উত্তরণে আবাসন খাতের ক্রেতাদের জন্য স্বল্প সুদের বিশেষ ঋণ তহবিল গঠন করতে হবে। রিহ্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া মিলন বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা এখন খারাপ। ক্রেতারা কিস্তি দিতে পারছেন না। ক্রেতারা টাকা ধরে রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। ইতোমধ্যে আবাসন শিল্পের সার্বিক পরিস্থিতি ও সমস্যা সমাধানে বর্তমান সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে রিহ্যাব। সরকারও আমাদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে।

স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর অন্যান্য খাতে নতুন করে সম্ভাবনা দেখা দিলেও সরকারের বাস্তবমুখী উদ্যোগ না থাকায় আবাসনখাতের স্থবিরতা যেন আগের চেয়ে বেড়েছে। দেশকে অশান্ত ও অস্থিতিশীল করে তুলতে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের নানামুখী ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং জমি ও ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়ে উচ্চ নিবন্ধন ফি, নির্মাণসামগ্রীর নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চমূল্য এবং ড্যাপ বা নগর পরিকল্পনা নিয়ে অনিশ্চয়তা আবাসনখাতের স্থবিরতাকে প্রকট ও দীর্ঘস্থায়ী করেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, নতুন করারোপ, নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির মতো অর্থনৈতিক বাস্তবতা আবাসনখাতের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে গতি সঞ্চারের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাই অন্যান্য বিষয়গুলোর সাথে সাথে আবাসনখাতে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগের প্রতিবন্ধকতা কমিয়ে আনার পদক্ষেপ না থাকায় স্থবিরতা দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আবাসনখাতে আরো জোর দেয়া উচিত।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ছিদ্দিকুর রহমান সরকার ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপের সংশোধিত বিধিমালা ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করেছে রাজউক এবং মন্ত্রণালয়। আজ সোমবার সংশোধনীর সুপারিশ প্রণয়নে উপদেষ্টাদের চূড়ান্ত বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। যদিও শেষ সময়ে তা পরিবর্তন হয়ে আগামী ১০ মার্চ নির্ধারণ করা হয়েছে। রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, রাজউক থেকে মন্ত্রণালয়ে ড্যাপকে আরো সহজীকরণে অতিরিক্ত কিছু সুপারিশও দেয়া হয়েছে। উপদেষ্টাদের আগামী বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ছিদ্দিকুর রহমান সরকার বলেন, আশা করছি এটি চূড়ান্ত হলে আর কোনো অলোচনার বিষয় থাকবে না।

যদিও বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ড্যাপের বর্তমান সুপারিশ এ ১৬ ফিট রাস্তার নিচে যারা বাড়ি বানাবে তাদের জন্য কোনো সুখবর নেই। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে বেশ সুফল পাওয়া যেতে পারে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে পাঁচ মাস ধরে ফ্ল্যাট বিক্রি কম থাকায় ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে। কর্মীদের বেতন ও অফিসের ভাড়া পরিশোধ করতেও হিমশিম খাচ্ছে তারা। অনেক উদ্যোক্তা নির্মাণ ব্যয়ের চেয়েও কম দামে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। উদ্যোক্তারা আশাবাদী, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হলে আবাসনখাতেও গতি ফিরবে।

নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এনজাক ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুনুর রশিদ বলেন, নির্মাণসামগ্রীর উচ্চমূল্যের কারণে খাতটি দীর্ঘদিন ধরেই সঙ্কটে ছিল। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ, আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ী ও আমলারা বিনিয়োগ করছেন না, ফলে বাজারে মন্দাভাব আরো প্রকট হয়েছে।

প্লট বা জমি বিক্রিতেও একই অবস্থা। ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের নির্বাহী মহাব্যবস্থাপক ফাহাদুজ্জামান বলেন, বর্তমানে বিনিয়োগের পরিবেশ অনুকূল না থাকায় মানুষের প্লট কেনার আগ্রহ কমেছে। আমরা ব্যবসায় সন্তোষজনক অবস্থায় নেই।

গ্রিন হাট রিয়েল এস্টেটের পরিচালক মেজবা উদ্দিন মারুফ বলেন, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ফ্ল্যাট বিক্রি ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমে গেছে। প্রতি মাসে যেখানে পাঁচ থেকে আটটি ফ্ল্যাট বিক্রি হতো, এখন তা কমে দুটিতে দাঁড়িয়েছে। যাদের খুব প্রয়োজন, তারাই এখন কিনছেন। শেলটেক (প্রা.) লিমিটেডের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা শাহজাহান রায়হান বলেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে ২০২৪ সালে বিক্রি ২০ শতাংশ কমে গেছে। গ্রাহকরা বিনিয়োগ করতে দ্বিধায় ভুগছেন। ব্যক্তিগত বাড়ি নির্মাণেও স্থবিরতা চলছে। টিকাটুলির বাসিন্দা রাশেদুল ইসলাম মার্চে বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা করলেও চলমান পরিস্থিতির কারণে তা স্থগিত রেখেছেন।

এদিকে দেশের ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদদের একটি অংশ সবসময় আবাসনে বিনিয়োগ করতেন। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে অনেক ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ আত্মগোপনে চলে গেছেন। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আবাসনে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ হওয়ায় বিনিয়োগও কমেছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সময়ে নতুন ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাস্তবায়ন করেছে, যা ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে কার্যকর। তবে উদ্যোক্তাদের দাবি, নতুন ড্যাপ বৈষম্যমূলক এবং এটি আবাসন খাতের জন্য মারণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা দ্রুত ড্যাপ সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন।

অবশ্য ড্যাপ বাস্তবায়ন মনিটরিং ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধনীর সুপারিশ প্রণয়ণে আজ সচিবালয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় জরুরি বৈঠক ডেকেছিল। যদিও এই বৈঠকটির সময় পরিবর্তন করা হয়েছে। আগামী ১০ মার্চ এই সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে সূত্র জানিয়েছে। বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সাত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং ৯ সচিব উপস্থিত থাকবেন। উপদেষ্টাদের মধ্যে থাকছেন ভূমি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ, সড়ক পরিবহন ও সেতু, আইন বিচার ও সংসদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারা। এছাড়া সচিবদের মধ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, ভূমি মন্ত্রণালয়, সেতু বিভাগ, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত, বিদ্যুৎ বিভাগ, রেলপথ মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব সভায় উপস্থিত থাকবেন বলে সূত্র জানিয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করবেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবুল বাকের মো. তৌহিদ স্বাক্ষরিত জরুরি সভার এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা গেছে।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে ফ্ল্যাট বিক্রি কিছুটা কমেছে। আগে যারা বড় আকারের ফ্ল্যাট কিনতেন, তারা এখন নিজেদের সম্পদ বিক্রি করছেন। তিনি জানান, নতুন ড্যাপ বাস্তবায়নের পর থেকেই আবাসন খাত মন্দার মুখে পড়েছে এবং উদ্যোক্তারা রাজউকে নতুন প্ল্যান পাস করানো বন্ধ রেখেছেন।

Source link

Leave a Reply

Back to top button