সমুদ্রে তীব্র তাপপ্রবাহে বছরে দেশে বিলিয়ন ডলার ক্ষয়ক্ষতি: গবেষণা


জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ রেকর্ড পরিমাণে বাড়ছে। এর ফলে বঙ্গোপসাগরসহ অন্যান্য সমুদ্রে ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও হচ্ছে ঘন ঘন। এতে বাংলাদেশে সাইক্লোনজনিত বার্ষিক ক্ষতি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দারা চরম জীবিকা সংকটে পড়ছেন।

জলবায়ু সংক্রান্ত বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ন্যাচার ক্লাইমেট চেঞ্জ’ এর প্রকাশিত নতুন এক গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। শুক্রবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় সকালে বৈশ্বিক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

গবেষণা বলছে, ২০২৩ ও ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের সংখ্যা আগের যে কোনো বছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৫ গুণ বেশি ছিল। এল নিনোর কারণে গত দুই বছরে, জলবায়ু পরিবর্তন আরও তীব্র হয়েছে এবং সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের একাধিক রেকর্ডের জন্ম দিয়েছে। যা বিশ্বব্যাপী কয়েক বিলিয়ন ডলার সম্পদের ক্ষতির কারণ।

বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, যদি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও বন উজাড় চলমান থাকে, তাহলে এই শতকের শেষ নাগাদ সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ ২০-৫০ গুণ বেশি ঘন ঘন ও ১০ গুণ বেশি তীব্র হতে পারে। এসব প্রতিরোধে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন তারা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তীব্র সামুদ্রিক তাপমাত্রার কারণে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও এর তীব্রতা বাড়ছে। ২০২৩-২৪ সালে এশিয়া অঞ্চলজুড়ে একাধিক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, যার মধ্যে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ওপর আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় মোখা এবং ২০২৪ সালের ঘূর্ণিঝড় রিমাল উল্লেখযোগ্য। এই দুটি ঝড় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে কয়েক লাখ বাড়িঘর ধ্বংস করেছে এবং ৯০ লাখের বেশি মানুষ এতে সরাসরি আক্রান্ত হয়েছে। শুধু ঘূর্ণিঝড় রিমালে প্রায় ৬৮৮০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদহানি হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মহাসাগরের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষের খাদ্য ও কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমান সামুদ্রিক তাপমাত্রা এই গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টাকে হুমকির মুখে ফেলছে।

বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখিয়েছেন, গত দুই বছরে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রের বাড়তি তাপমাত্রার ফলে ব্যাপক কোরাল ব্লিচিং, মৎস্য ও সামুদ্রিক খামার বন্ধ, মৃত তিমি ও ডলফিনের ভেসে আসার সংখ্যা বেড়েছে। এমনকি এই ঘটনাগুলো স্থলভাগে তাপপ্রবাহ ও ভয়াবহ বন্যার মতো বিষয়গুলোকেও ত্বরান্বিত করছে।

তবে, কিছু দেশ আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কিছুটা কমাতে সক্ষম হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় বিপন্ন প্রজাতির রেড হ্যান্ডফিশের এক চতুর্থাংশকে হিটওয়েভের আগে অ্যাকুরিয়ামে রাখা হয় এবং পরে সাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাল ও সামুদ্রিক শামুককে গভীর ও ঠাণ্ডা পানিতে সরিয়ে নেওয়া হয়। পেরু সরকার তাদের একটি উপকূলীয় মৎস্যশিল্প বন্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছে।

বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, আরও কার্যকর পূর্বাভাস ব্যবস্থা এবং দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতে ক্ষয়ক্ষতি আরও কমানো সম্ভব।

যুক্তরাজ্যের মেরিন বায়োলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের গবেষক ড. ক্যাথরিন ই স্মিথ বলেন, সর্বোপরি সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ এবং এর প্রভাব থেকে বাঁচতে হলে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। আপাতত, কিছু সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ কিছুটা সফলতা দেখিয়েছে, কিন্তু এগুলো স্থায়ী সমাধান নয়।

প্রবন্ধের লেখক ও ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার সিনিয়র লেকচারার ড. কারেন ফিলবি-ডেক্সটার বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ ক্রমাগত রেকর্ড ভেঙে নতুন মাত্রায় পৌঁছাচ্ছে, যা আমাদের আধুনিক ইতিহাসে কখনো দেখা যায়নি। এই চরম উষ্ণতা সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করছে, মৎস্যশিল্পের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে এবং চরম আবহাওয়ার মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলছে। আমরা যদি এখনই বৈশ্বিক কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেই, তাহলে সামুদ্রিক তাপমাত্রা আরও ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছাবে।

আরএএস/এএমএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।



Source link

Exit mobile version