
আমরা জানি, পৃথিবী পৃষ্ঠের ৭১ শতাংশ পানি ও ২৯ শতাংশ স্থলভাগ এবং এই পানির একটি বড় অংশই সমুদ্র। সমুদ্র শুধুমাত্র সৌন্দর্যের অংশ নয়, বরং এটি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমুদ্রের মাধ্যমে পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এটি বিশ্বের খাদ্য ও অক্সিজেনের অন্যতম উৎস। দুখঃজনক হলেও সত্যি, আমাদের এই অপূর্ব সৌন্দর্যের জলরাশির সমুদ্রগুলো আজ দূষণের শিকার। আর এই দূষণের প্রধান কারণ প্লাস্টিক বর্জ্য, রাসায়নিক বর্জ্য, জাহাজের বর্জ্য, তেল নিঃসরণ, পর্যটন খাতের বর্জ্য এবং যেটি না বললেই নয় ও উদ্বেগজনক সেটি হলো গ্লোবাল ওয়ার্মিং অথবা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।
প্রতি বছর প্রায় ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ফেলা হয়। যেহেতু প্লাস্টিক পঁচনশীল নয় তাই এটি হারিয়ে যায় না, ধীরে ধীরে মাইক্রো প্লাস্টিকে পরিণত হয় এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দেয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিক ভক্ষণের কারণে সামুদ্রিক কচ্ছপ প্রজননে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে মাছের পরিমাণের চাইতে প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি হবে। যেটি বড় একটি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
প্লাস্টিক দূষণ রোধে আমাদের অবশ্যই প্লাস্টিক রিসাইক্লিং পদ্ধতি বাড়াতে হবে। ওয়ানটাইম ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাঁচ, ধাতু বা পুনঃব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহার করতে হবে। বায়োডিগ্রেডেবল পদ্ধতি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি, জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্কুল-কলেজ, গণমাধ্যম এবং সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে। গবেষণা বাড়াতে হবে এবং বিকল্প পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি নিয়ে আসতে হবে।
জাহাজ থেকে তেল নিঃসরণের মাধ্যমে সমুদ্র দূষণ হচ্ছে। গবেষণা মতে, ১ ফোটা তেল কমপক্ষে ২৫ লিটার পানিকে দূষিত করতে পারে। যেহেতু তেল পানির উপরে একটি আস্তরণ সৃষ্টি করে এতে করে সামুদ্রিক প্রাণী শ্বাসপ্রশাসে বাধাগ্রস্থ হয়। অন্যদিকে, বিশ্বের সকল বাণিজ্যিক জাহাজ কমপক্ষে ১ মাস থেকে ৬ মাস পর্যন্ত সমুদ্রে অবস্থান করে এবং প্রতিটি জাহাজ থাকে প্রায় ১০-২৫ টন জ্বালানি বর্জ্য সমুদ্রে ফেলা হয় এতে করে সমুদ্র দূষিত হচ্ছে। আর প্রতিনিয়ত এই সমস্যাটি বেড়েই চলেছে।
জাহাজ থেকে তেল নিঃসরণ রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে, সমুদ্র পরিবহন সংস্থাগুলোকে আরও বেশি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করে তেলের উপর নির্ভরতা কমাতে হবে। যেহেতু, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা তাই জরুরি পরিস্থিতিতে তেল নিঃসরণ প্রতিরোধে দ্রুত আন্তজার্তিক পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে যাতে করে উন্নত প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষিত কর্মীদের মোতায়েন করানো হয়।
শিল্প-কলকারখানাগুলো থেকে নির্গত রাসায়নিক বর্জ্য এবং কৃষি শিল্পে ব্যবহৃত সার, কীটনাশক, বিষ ইত্যাদি পানির সাথে মিশে নদীর মাধ্যমে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে এতে করে সমুদ্র দূষিত হচ্ছে। সামুদ্রিক প্রাণী প্রতিনিয়ত হুমকির মধ্যে পড়ছে। পানির চক্র এর মান ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। কিছু জায়গাতে লবণাক্ততা তীব্র হচ্ছে।
শিল্প ও রাসায়নিক বর্জ্যর দূষণ কমাতে প্রতিটি শিল্প-কলকারখানায় উন্নত বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে। যতটা সম্ভব শিল্প-কলকারখানাগুলোকে নদী বা সমুদ্রের পাশ থাকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে হবে। কৃষি খাতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে নিয়মিত পরিবেশ পর্যবেক্ষণ চালু করা প্রয়োজন, যাতে দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনা যায়।
প্রতিনিয়ত পর্যটনে মানুষের যাতায়াত বেড়েই চলছে। পর্যটকরা প্লাস্টিক বোতল,ডাবের খোঁসা, খাবারের প্যাকেট, ও অন্যান্য আবর্জনা ফেলে দেন, যা সরাসরি সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। এছাড়া, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট থেকে নির্গত বর্জ্যও দূষণ বাড়াচ্ছে । অপরিকল্পিত পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিষ্কার-পরিছন্নতার অভাবের ফলে দূষণ আরও তীব্র হচ্ছে।
সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ও পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার, যাতে আবর্জনা সঠিকভাবে নিষ্পত্তি করা যায়।পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিষ্কার-পরিছন্নতা কর্মসূচি চালু করা উচিত। এছাড়া, পরিবেশবান্ধব পর্যটন বা ইকো-ট্যুরিজম প্রচলনের মাধ্যমে টেকসই পর্যটনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
সমুদ্র দূষণের অন্যতম কারণ গ্লোবাল ওয়ার্মিং অথবা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ এর কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এটি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ও প্রবাল প্রাচীরের জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে। কার্বনডাইঅক্সাইড, মিথেন এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস সমুদ্রের পানিতে শোষিত হয়ে এর অম্লতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। যার ফলে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। গ্রীন হাউস গ্যাস এর জন্য অন্যতম দায়ী কার্বনডাইঅক্সাইড, মিথেন এবং জলীয় বাষ্প। আমরা জানি যে, প্লাস্টিক, তেল,কয়লা ও বিভিন্ন ধরণের জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে কার্বনডাইঅক্সাইড তৈরী হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, মানব সৃষ্ট সকল কার্বনডাইঅক্সাইড এর ২৫ শতাংশ সমুদ্র শোষণ করে, যার ফলে সমুদ্র দূষিত হচ্ছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমানোর জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমে। ইকো ফ্রেন্ডলি প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারি। বিশ্বব্যাপী বন সংরক্ষণ ও ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করতে হবে, যাতে কার্বনডাইঅক্সাইড শোষণের হার বৃদ্ধি পায়। পরিবহন ও শিল্প খাতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য বিদ্যুৎ চালিত যানবাহন ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বোপরি, সমুদ্র দূষণ রোধে আমাদের মূলধারার পরিবর্তন করতে হবে। রিসার্চ বাড়াতে হবে, রিসার্চে ফান্ড রিলিজ করতে এবং রিসার্চের মাধ্যমে প্রত্যেকটি সমস্যার পরিবেশবান্ধব, সাস্টেনেবল বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে আসতে হবে। আমাদের জনসচেতনতার আগে ব্যক্তি সচেতনতায় উদ্যোগী হতে হবে। পরিবেশের প্রতি অবিচার বন্ধ করতে হবে। পরিবেশ ও সমুদ্র দূষণ হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
যেহেতু, সমুদ্র দূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা তাই সমুদ্র দূষণ রোধে সমন্বিত উদ্যোগই একমাত্র পথ। তাই আমাদের ব্যক্তিগত, স্থানীয়, সরকারি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একযোগে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে করে আমরা তবৎড় Zero Ocean Pollution এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হই।
লেখক: শিক্ষার্থী, চায়না ওয়েস্ট নরমাল ইউনিভার্সিটি, চায়না।
[email protected]