
সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনীকে বিব্রত করার পুরোনো নোংরামি নতুন ডালা মেলছে। বীজ-সার দিয়ে বিষবৃক্ষটিকে তাজা করার চেষ্টা বেশ জোরদার। ভারতীয় কয়েকটি গণমাধ্যমসহ দেশি-বিদেশি মহলের এ কুচেষ্টা কয়েক দফায় মার খেলেও দমছে না চক্রটি। দম নিয়ে আবার নেমেছে। জাতীয় ঐক্যের বাতাবরণ, সেনাপ্রধানের বক্তব্যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন সেক্টরে আশাবাদ, দেশে কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনের অভিযাত্রাসহ আশপাশের সুবাতাসে চক্রটি ভারাক্রান্ত। এটি তাদের ভীষণ নাপছন্দ। তারা চায় এখানে অস্থিরতার কালো মেঘ জমে থাকুক। অনিশ্চয়তা স্থায়ী হোক। সেই চাওয়া-পাওয়ায় বড় রকমের বাধা মনে করা হচ্ছে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে, তার নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীকে।
শেখ পরিবারের সদস্য, ক্ষমতার অভিলাষসহ কিছু বদনামে সেনা প্রধানকে বিদ্ধ করার অপচেষ্টার নতুন জার্নিতে যোগ হয়েছেন সেনাবাহিনীর সাবেক কিছু সদস্যও। বিপথগামিতা, হানিট্র্যাপে পড়া ওই সদস্যদের কয়েকজন বিদেশে বসে নানা কাল্পনিক তথ্য ছড়াচ্ছেন স্যোশালমিডিয়ায়। নানা নাম, আইডিতে ছড়ানো ওই কিচ্ছাগুলো মূলত একই জায়গা থেকে রচনা করা। নতুন করে খুব জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, জেনারেল ওয়াকার শেখ পরিবারের সদস্য। তিনি নতুন করে জন্ম নেননি। অথবা নতুন আরেকটি বিয়েও করেননি। কোনো ব্যক্তি কোনো পরিবারের সদস্য হন জন্মগতভাবে। বা বৈবাহিক সূত্রে।
উইকিপিডিয়া বলছে, ওয়াকারের জন্ম একবারই ১৯৬৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর শেরপুরে। স্ত্রী সারাহনাজ কামালিকা রহমান। তিনি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমানের মেয়ে। সেইসূত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো বোনের স্বামী জেনারেল ওয়াকার। এ সম্পর্ক বিবেচনায় তাকে শেখ পরিবারের সদস্য বানানোর একটি অপচেষ্টা থাকাই স্বাভাবিক। সেই খুনসুটি টানার চেষ্টা বিফলে গেছে কবেই। নতুন করে তা সামনে টেনে আনার মতলব কোনো সাধারণ মানুষেরই বোধগম্য নয়। তিনি সেনাপ্রধান হওয়ার মাসখানেক পরই নানা ঘটনার অনিবার্যতায় রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদল। যা বিগত শাসকদের মতো আরো কিছু ব্যক্তি ও মহলের জন্য কেবল অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, কল্পনারও বাইরে। সেই ঝাল মেটাতে নানা বদনাম, গুঞ্জন, গুজবই তাদের ভরসা।
নো ফায়ার নির্দেশনায় এই সেনাপ্রধান কেবল চব্বিশের আগস্টে ছাত্র-জনতার দিকে তাক করা গুলিই থামাননি। ছাত্র-জনতার পালস্ বুঝেছেন। সেনাবাহিনীকে ক্ষমতামুখী না করে জনতামুখী করেছেন। যেখানে পুলিশসহ ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা ছাত্র-জনতাকে হতাহত করে সেখানে সেনাসদস্যরা তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। তা ইতিহাস হয়ে থাকছে। কথা কম বলার স্বভাবের ওয়াকার এখনো সংরক্ষণবাদী।
নতুন গুজবে যোগ করা হয়েছে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা নেয়ার কথা। এখন কেন? জেনারেল ওয়াকার তা নিতে পারতেন আরো আগেই। এসএসএফের গান পয়েন্টে দাঁড়িয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রক্তাক্ত দেশকে মিনিট কয়েকের মধ্যে একটি শান্ত বন্দোবস্তে আনা ক্ষমতা নেয়ার চেয়ে কঠিন ছিল। তিনি কঠিন কাজটিই করেছেন।
এরপরও সেনাপ্রধান বারবার বলছেন, তাদের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য নেই। এরপরও তোতাপাখির মতো শেখানো বুলিতে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা নেয়ার কল্পকাহিনী রটানোতে ক্ষ্যান্ত নেই মহলবিশেষের। কাহিনীকে রং লাগাতে গিয়ে আশপাশে নানা অবান্তর কথামালা, কিচ্ছা, কনটেন্ট। একেবারে আদা জল খেয়ে নামা।
নো ফায়ার নির্দেশনায় এই সেনাপ্রধান কেবল চব্বিশের আগস্টে ছাত্র-জনতার দিকে তাক করা গুলিই থামাননি। ছাত্র-জনতার পালস্ বুঝেছেন। সেনাবাহিনীকে ক্ষমতামুখী না করে জনতামুখী করেছেন। যেখানে পুলিশসহ ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা ছাত্র-জনতাকে হতাহত করে সেখানে সেনাসদস্যরা তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। তা ইতিহাস হয়ে থাকছে।
কথা কম বলার স্বভাবের ওয়াকার এখনো সংরক্ষণবাদী। কমের মধ্যে কথা যা বলেন, পুরোটাই সোজাসাপ্টা। ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নিয়ে মাঠে কর্মরত সেনা সদস্যদের নির্দেশনা দিয়েই রেখেছেন, অতিরিক্ত বল প্রয়োগে না যেতে। এখানেও মেধা এবং ধীবুদ্ধির এক রসায়ন। বাহিনীকে নির্দেশ দেয়াই আছে নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে করে যাওয়ার।
এর আগে সেনাপ্রধান সরাসরি সেইসব মানুষকে সতর্ক করেছেন, যারা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতায় ইন্ধন জোগানোর অপচেষ্টা করছেন এবং বিভাজন ও মেরুকরণের রাজনীতিতে শান দিচ্ছেন। এতে যে আখেরে দেশ এবং দেশবাসীরই ক্ষতি হবে, সেকথা স্পষ্ট ভাষায় বলতে দ্বিধা করেননি ২৫ ফেব্রুয়ারিতে রাওয়ার অনুষ্ঠানে। বলেছেন, ‘আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। পরে বলবেন যে আমি সতর্ক করিনি!
আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি-কাটাকাটি করেন, এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমি আজকে বলে দিলাম, নইলে আপনারা বলবেন যে আমি আপনাদের সতর্ক করিনি! আমার অন্য কোনও আকাঙ্ক্ষা নাই। আমার একটাই আকাঙ্ক্ষা – দেশ এবং জাতিটাকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে ছুটি গ্রহণ করা। গত সাত-আট মাস ধরে অনেক সহ্য করেছি। যথেষ্ট হয়েছে।
কথা কিন্তু, আর বেশি লাগে না। উপর্যুক্ত কয়েক কথার মাঝে অনেক ম্যাসেজ। সামনে দুষ্টামির সুযোগ নেই, নিয়ন্ত্রণসহ নিয়মের মধ্যে আসতেই হবে -বার্তাটি দুষ্টদের কাছে বেশি পরিষ্কার। সেই দৃষ্টে তারা নেমেছে ছলচাতুরিসহ নানা কারসাজিতে। বিভ্রান্তি-গুজবই তাদের প্রধান ভরসা। প্রতিবেশী দেশের গণমাধ্যম থেকে সেই সাপোর্ট মিলছে ব্যাপক-বিস্তরভাবে। ওয়াকার বিডিআর হত্যাযজ্ঞের সময় নীরব দর্শক ছিলেন বলে নতুন একটি তত্ত্ব ছড়ানো হচ্ছে। তত্ত্বটিকে সত্য প্রমাণের চেষ্টায় ব্রিগেডিয়ার হাকিমের সাথে ওয়াকারের ওই সময়ের একটি ছবিও ছড়ানো হচ্ছে। আসল ব্যাপার হচ্ছে, ওই সময় ৪৬ ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাকিম। তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ওয়াকার-উজ-জামান।
চেন অব কম্যান্ড অনুযায়ী ওয়াকার তো হাকিমের অধীনে ধীর-নিরবই থাকবেন। ৫ আগস্ট যখন তার ওপর খবরদারির কোনো হাকিম ছিলেন না, সেদিন ওয়াকার-উজ-জামান যা করার করেছেন। যার বেনিফিশিয়ারি গোটা বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য অতীতে যারা অপচেষ্টা করেছেন তারা হয় পালিয়ে গেছেন অথবা নিহত হয়েছেন- অনেকের লাশ পড়েছিল রাস্তায়। এদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন জনগণ, বারবার তা রক্ষা করার জন্যও তারা বীরত্ব দেখিয়েছে। সেখানে জনতার সারথীর মতো এবার যোগ হয়েছে সেনাবাহিনীর বীরত্ব।
সেইসঙ্গে সেনাপ্রধান সর্বশেষ যোগ করেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ঝুঁকির বিষয়। বুঝবানদের তা বুঝতে সময় লাগেনি। ভূরাজনৈতিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো বাংলাদেশ। তাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো শক্তি যদি ষড়যন্ত্র করে, তখন জনগণ স্বাভাবিকভাবেই অন্য শক্তির সহায়তা পাবেন, অতীত ইতিহাস তাই বলে। দেশ রক্ষার জন্য জনগণ সবসময়ই সতর্ক থাকে এবং অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করে। এই পাহারায় সেনা ও জনতার সম্মিলনে কি-না সম্ভব, সেই দৃষ্টান্ত ও নেতৃত্ব তো ওপেন, ক্লিয়ার অ্যান্ড লাউড।
জেনারেল ওয়াকারের পেশাগত জীবন বড় বর্ণাঢ্য। ১৯৮৫ সালের ২০ ডিসেম্বর ১৩তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন তিনি। গ্র্যাজুয়েশন করেছেন মিরপুরের ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ এবং যুক্তরাজ্যের জয়েন্ট সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ থেকে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘মাস্টার্স অব ডিফেন্স স্টাডিজ’ এবং যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে ‘মাস্টার্স অব আর্টস’ ইন ডিফেন্স স্টাডিজ ডিগ্রি অর্জন। একজন ক্রীড়ামোদী, মিতভাষী কিন্তু প্রাণবন্ত অফিসার হিসেবে সেনাবাহিনীতে ভিন্নমাত্রার পরিচয় তার। দীর্ঘ ৩৯-৪০ বছরের বর্ণাঢ্য সামরিক জীবন কমান্ড, স্টাফ ও প্রশিক্ষকের অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ।
২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১০ সালের ৮ জুন পর্যন্ত ১৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক ও অধিনায়কের দায়িত্ব পেশাদারিত্বের মানদণ্ডে সংশ্লিষ্টদের কাছে স্মরণীয়। ২০১১ সালের ২৭ জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত দুই বছরেরও বেশি সময় ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জিওসি হিসেবে ২০১৪ সালের ২ এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন বছর নবম পদাতিক ডিভিশন কমান্ড করেন। এরিয়া কমান্ডার, সাভার এরিয়া ও জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) নবম পদাতিক ডিভিশন হিসেবে তিনি টানা তিন বছর (২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬) বিজয় দিবসে প্যারেড কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘সেনাগৌরব পদক’ (এসজিপি)-এ ভূষিত হন। স্টাফ হিসেবে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত একটি ব্রিগেড, স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকস (এসআইএন্ডটি) এবং সেনাসদরে বিভিন্ন পদায়ন ও নিয়োগে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি প্রশিক্ষক হিসেবে জেসিও এনসিও একাডেমি (জেএনএ), স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকস ও বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস সাপোর্ট অ্যান্ড ট্রেনিংয়ে (বিপসট) সুনামের সঙ্গে সব পদবির দেশি-বিদেশি সেনাসদস্যদের প্রশিক্ষণ দেন। সেনাসদর সামরিক সচিব শাখায় সহকারী সামরিক সচিব, উপ-সামরিক সচিব এবং সামরিক সচিব-এমএস) হিসেবেও বিভিন্ন মেয়াদে দীর্ঘদিন দায়িত্বরত ছিলেন। সেনাসদর, জিএস শাখার চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও-এএফডি) হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে কর্মরত ছিলেন।
জাতিসংঘের ব্যানারে মিলিটারি অবজার্ভার হিসেবে এংগোলাতে এবং সিনিয়র অপারেশন অফিসার হিসেবে লাইবেরিয়াতে দায়িত্ব পালন করেন। সেনাবাহিনীতে তার কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি ‘অসামান্য সেবা পদক’ (ওএসপি)-এ ভূষিত হন। দেশবিদেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও কনফারেন্সে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইমেজ উজ্জ্বল করেছেন। জীবনের এক পর্যায়ে এসে দেশের এক চরম সন্ধিক্ষণেও সাফল্যের মাত্রা যোগ ঘটাতে পেরেছেন। মহল বিশেষের গা জ্বালা সেখানেই।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
এইচআর/এএসএম