Status

রাজধানীতে জমজমাট বাহারি ইফতারির বাজার

রমজান এলেই রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে আসে সুস্বাদু ও মুখরোচক বিভিন্ন খাবার। বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়Ñ নামের একটি বিশেষ ইফতারি পাওয়া যায় পুরান ঢকার বাজারে। তবে খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু ইসলামেও যেমন আলাদা গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি গুণগত মানের কারণে তাৎক্ষণিক শক্তি জোগান দানে খেজুর অতুলনীয় একটি খাদ্যদ্রব্য। সারাদিন রোজা রাখার পর মানবদেহের টিস্যুগুলো ঝিমিয়ে পড়ে, তাৎক্ষণিকভাবে কর্মশক্তি জোগাতে ইফতারে পানি ও খেজুরকে প্রাধান্য দেয়া হয়। দেশীয় সংস্কৃতিতেও বিভিন্ন অঞ্চলের নানারকম খাবারের সাথে খেজুর মিশে গেছে অনেক আগে থেকে। রমজান এলেই রাজধানীর বাজারগুলোতে নানা জাতের খেজুরের পাশাপাশি বাড়ে হরেকরকমের খাবারের চাহিদা। শত বছরের পুরোনো সংস্কৃতির খাবার নিয়ে হাজির হন দোকানিরা।

গতকাল পবিত্র রমজানের প্রথম দিনেই রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন রাস্তা ও অলিগলিতে ইফতার বাজার জমে উঠেছে। দুপুরের পর থেকেই ইফতারসামগ্রী নিয়ে অলি-গলিতে দোকান খুলতে শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। তবে ক্রেতা বাড়তে শুরু করে বিকেল থেকে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, প্রচলিত ইফতারির পাশাপাশি নানান স্বাদের বাহারি আয়োজন সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা।

পুরান ঢাকায় বাহারি ইফতারের জন্য বিখ্যাত চকবাজার। এ বাজারে ইফতারির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়Ñ নামের একটি বিশেষ ইফতারি। এটি কিনতে ক্রেতাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায় তৈরিতে মাংস, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, ডাবলি, বুটের ডাল, ডিম, মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনা মরিচসহ নানা পদের খাবার আইটেম এবং হরেক ধরনের মসলা প্রয়োজন হয়। প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৪৮০ টাকা দরে এটি বিক্রি হচ্ছে। জানা যায়, ৬৮ বছর আগে ১৯৪৫ সালে শাহী জামে মসজিদ চত্বরে বাণিজ্যকভাবে এ খাবার বিক্রি শুরু করেন জনৈক ব্যক্তি। সেই খাবারটি এখন পুরান ঢাকাসহ গোটা রাজধানীতে একটি আকর্ষণীয় ইফতারির আইটেম হিসেবে পরিচিত।
রাজধানীর বেইলি রোডেও ক্রেতাদের ভিড় দেখা যায়। ইফতারসামগ্রীর মধ্যে নবাবী শাহী হালিম, ঘি ও জাফরানে ভাজা নবাবী স্পেশাল শাহী জিলাপি, নবাবী জর্দা, নবাবী ক্ষিরসা ফালুদা, নবাবী জাফরানি পেস্তা বাদাম শরবত, নবাবী বোরহানিসহ নানা আইটেম। ইফতার কিনতে এসে সাদ্দাম বলেন, বেইলি রোডে নানা রকমের ইফতারি পাওয়া যায়, তবে ইফতারের দাম একটু বেশি। প্রথম রোজা তাই ইফতারে আইটেম একটু বেশি করতে এখানে এসেছি।

রাজধানীর অলি-গলি, রাস্তার পাশের ইফতারসামগ্রী থেকে রেস্তোরাঁর ইফতার সামগ্রীর দামের পার্থক্য পিসপ্রতি পাঁচ থেকে ১০ টাকা। আর যেসব সামগ্রী কেজি আকারে বিক্রি হচ্ছে সেখানে দামের পার্থক্য ১০ থেকে ২০ টাকা করে। নুরুল আলম বলেন, প্রতি পিস ডিম চপ ৩০ টাকা, ভেজিটেবল টোস ৪০ টাকা, চিকেন টোস ৫০ টাকা, ভেজিটেবল রোল ৪০ টাকা, চিকেন রোল ৫০ টাকা। এছাড়া সব ধরনের টিক্কা বিক্রি হচ্ছে পিসপ্রতি ৫০ টাকা করে।

এবারের রমজানে খেজুরের দাম সব শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই। নানা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খেজুরে আছে ক্যালরি, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ফাইবার, আয়রন, ফসফরাস, পটাশিয়ামসহ নানা প্রাকৃতিক উপাদান। খেজুরের নানাবিধ উপকারে মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এছাড়া হৃৎপি-ের সবচেয়ে নিরাপদ ওষুধ খেজুর। পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ও প্রাকৃতিক আঁশে পূর্ণ খেজুর ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। যারা নিয়মিত খেজুর খান, তাদের বেলায় ক্যান্সারের ঝুঁকিটাও অনেক কম থাকে। খেজুরে থাকা আয়রন ও ফাইবার কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। প্রচুর পটাসিয়াম পাওয়া যায় খেজুর থেকে। এটি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এছাড়া মাত্র কয়েকটি খেজুর ক্ষুধার তীব্রতা কমিয়ে দেয় এবং পাকস্থলিকে কম খাবার গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। অল্পতেই শরীরের প্রয়োজনীয় শর্করার ঘাটতি পূরণ করে শরীরে এনার্জি আনে। খেজুরের পুষ্টিগুণ প্রচুর। সুগারের পরিমাণ এত বেশি থাকে খেজুরে যে, এক কামড়েই অনেকটা এনার্জি পাওয়া যায়। এর মধ্যে আয়রন, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফাইবার, গ্লুকোজ, ম্যাগনেশিয়াম ও সুক্রোজ থাকে। যে কারণে খেজুর খাওয়ার মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে শরীরে এনার্জি বেড়ে যায়। সারা দিন উপোস করে শরীরে ক্লান্তি আসে, তা দূর করে এনার্জি জোগাতে সাহায্য করে খেজুর। খালি পেটে থাকলে সাধারণত অ্যাসিডিটি হয়। যার থেকে অস্বস্তি হতে থাকে। খেজুর শরীরে অ্যাসিডের মাত্রা বশে রেখে অস্বস্তি কমায়। সারা দিন না খেয়ে থাকলে খেজুর খাওয়ার সময় বেশি খেয়ে ফেলার প্রবণতা তৈরি হয়। খেজুর খেয়ে রোজা ভাঙলে এর মধ্যে থাকা জটিল কার্বোহাইড্রেট হজম হতে বেশি সময় নেয়। ফাইবার থাকার কারণে পেট ভরা লাগে। তাই বেশি খাওয়ার আগেই পেট ভরে যায়। অনেক ক্ষণ না খেয়ে থাকলে তা পৌষ্টিকতন্ত্রের কার্যকারিতায় ব্যাঘাত ঘটায়। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও হতে পারে। খেজুর শরীরে উৎসেচক ক্ষরণে সাহায্য করে। ফলে হজম ভালো হয়। তবে ইফতারে যদি খেজুর না পাওয়া যায়, তাহলে পানি পান করা উচিত। কারণ উভয়ই বিশুদ্ধ এবং নিরাময়কারী।

দেশীয় বাজারে বহু জাতের খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে ইরাকি জায়েদি খেজুরের। এ ছাড়া নি¤œবিত্তের ভরসায় আছে নরম বরই জাতের খেজুর। গত বছরের তুলনায় নরম বরই খেজুর ৩০ থেকে ৪০ টাকা কমে কেজিতে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, জায়েদি খেজুর কেজি ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা কমে ৩৫০ থেকে ৩৭০ টাকা, আজোয়া খেজুর কেজিতে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কমে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, মেডজল খেজুর কেজিতে ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা কমে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা এবং মাবরুম খেজুর কেজিতে ৪০০ টাকা কমে এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে বহুল চাহিদা থাকা জায়েদি খেজুর পাইকারিতে ১০ কেজি কার্টনের দাম এক হাজার ৭০০ টাকা থেকে এক হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বস্তার খেজুর ১২৫ টাকা থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এবার খেজুরের আমদানি বেশি থাকায় জায়েদি খেজুরের দাম আরো কমে আসতে পারে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা। জানা যায়, ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে ঋণপত্র খোলার মার্জিনসহ বিভিন্ন শর্ত শিথিলের কারণে ও ডিউটি মূল্য কমানোর কারণে আমদানিকারকরা এবার প্রচুর খেজুর আমদানি করেছে। গত বছর ডিউটিসহ বিভিন্ন জটিলতার কারণে তারা আমদানির সুযোগ পায়নি। বাজারে এমন অবস্থা চলমান থাকলে খেজুরের দাম ও সরবরাহ অনেক সহজ হবে। দীর্ঘদিনের চলমান বাজার ব্যবস্থার জন্য রমাজানে খেজুর নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে অস্বস্তিকর অবস্থা ছিল। আমদানি বৃদ্ধি ও সুবিধার জন্য এ বছর খেজুরের দাম ও সরবরাহ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। বন্দর ও জাহাজে আরো ৩০ শতাংশের মতো খেজুর আছে। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই লাভজনক অবস্থায় থাকবে।

ব্যবসায়ীরা বলেন, গত বাজারে হাজী সেলিমের মদিনা ও নজরুল ইসলামের নাসা সিন্ডিকেট করে একচেটিয়া খেজুর আমদানি করে সেগুলো সংরক্ষণ করে, শোরুম খুলে খেজুর বিক্রি করেছে। বাজারে খেজুরের সঙ্কট ও দাম বেড়েছে। ঋণপত্র খোলার মার্জিনসহ বিভিন্ন শর্ত শিথিলের কারণে এবার ছোট ছোট আমদানিকারকরা ব্যবসা করার সুযোগ পেয়েছেন। তাই রমজানের বাজার নিয়ে ক্রেতাদের দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে না।

ফ্রেশ ফ্রুটস অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, দেশে রমজান মাসে ৪০ হাজার টন খেজুর প্রয়োজন হয়। এছাড়াও দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা ৬০ থেকে ৯০ হাজার টন। খেজুরগুলো মূলত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিসিয়া, মিসর, জর্দান, ইরাক, ইরান ও পাকিস্তান থেকে আমদানি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ইরাকি জায়েদি খেজুরের। রমজানকে কেন্দ্র করে ৪৮ দিনে আমদানি হয়েছে বিভিন্ন জাতের ৩১ হাজার ৬৪৩ টন খেজুর, যা মোট আমদানির ৭০ শতাংশ। পাইপ লাইনে থাকা বাকি ৩০ শতাংশ আগামী সাত দিনের মধ্যেই বাজারে আসবে। অথচ গত বছর খেজুর আমদানির পরিমাণ চলতি বছরের তুলনায় বেশি হলেও খোলা বাজারে পর্যাপ্ত খেজুর ছিল না।

Source link

Back to top button