রাঙামাটির বন্দুকভাঙা- যেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত এক ভয়াল জনপদ!

পার্বত্য জেলা রাঙামাটির বন্দুকভাঙা এখন যেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত এক ভয়াল জনপদ। বন্দুকভাঙ্গা রেঞ্জের মারিচুগ মৌন ও যমচুগ এলাকায় জেএসএস (মূলদল) এবং ইউপিডিএফ (মূলদল) এর টানা কয়েক দিনের সংঘাতের পর সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় বিপুল গোলাবারুদ। পুরো এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ওই দুই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ভয়ঙ্কর দৌরাত্মের ভয়াবহ সব নিদর্শন। সন্ত্রাসীদের পদভারে প্রকম্পিত ওই জনপদের বাসিন্দারা চরম আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে বলে জানা গেছে। ওই এলাকার বাসিন্দারা জানান,
রাঙামাটির বন্দুক ভাঙ্গা রেঞ্জের মারিচুগ মৌন ও যমচুগ এলাকা ভয় আর আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে বিপর্যস্ত সেখানকার জনজীবন। দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস মূলদল) এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ মূলদল) রাঙামাটির বন্দুকভাঙা এলাকাকে সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে রেখেছে। উক্ত এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গত ২ জানুয়ারি ওই এলাকায় সেনাবাহিনী অবস্থান নেয় এবং সন্ত্রাস দমনে অভিযান চালায়, উক্ত অভিযানে নিহত হয় ইউপিডিএফ (মূলদল) দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসী। অভিযানে উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ, ধ্বংস করা হয় সন্ত্রাসীদের একাধিক ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেনাবাহিনীর অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে অস্থিরতা কিছুটা প্রশমিত হলেও, সেনাবাহিনী এলাকাটি ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। যার ফলশ্রুতি ভয় আর আতঙ্কের এলাকা ছাড়া হয় স্থানীয় জনগণ।
উক্ত এলাকায় গত ২ মাস ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গ্রুপগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা নতুন করে নিরাপত্তা সংকটের পাশাপাশি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিগত সময়ের তুলনায় এসব ঘটনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে, যা এলাকাটিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে, দুপুর ২টার দিকে জেএসএস (মূলদল) এবং ইউপিডিএফ (মূলদল) এর সশস্ত্র গ্রুপগুলো আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মারিচুগ মৌন পাহাড় দখলের চেষ্টা করে। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ রাউন্ড গুলি বিনিময় হয়। তবে, গোলাগুলির ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। নিরাপত্তা বাহিনীর একটি টহল দল ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর খবর পেয়ে সশস্ত্র গ্রুপগুলো এলাকা থেকে সরে পড়ে। উক্ত এলাকাটি অত্যন্ত দুর্গম হওয়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে খুঁজে বের করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।
স্থানীয়রা জানায়, ১৮ ফেব্রুয়ারি এবং ২১ ফেব্রুয়ারি পুনরায় এলাকায় জেএসএস (মূলদল) এবং ইউপিডিএফ (মূলদল) এর মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে, ২৩ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ টহল দল সেখানে যায়। তাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে সশস্ত্র গ্রুপ দুটি পুনরায় স্থান ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। অভিযানে জেএসএস (মূলদল) ও ইউপিডিএফ (মূলদল) সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত গোলা যত্রতত্র পড়ে থাকতে দেখা যায়, যার মধ্যে বিভিন্ন ক্যালিবারের মোট ২৪৭টি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়, আরও ছিল ৭.৬২ মিমি-এর ১২৯টি, ৫.৫৬ মিমি-এর ১১৫টি এবং ৭.৬২×৫৪ মিমি-এর ৩টি খোসা। এছাড়া, ফায়ার না হওয়া ৭.৬২ মিমি ও ৫.৫৬ মিমি ক্যালিবারের ১টি করে বুলেটও পাওয়া যায়। অভিযানের সময় সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়, যা তাদের তৎপরতার গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ বহন করে। এসব আলামত থেকে স্পষ্ট যে, এই গ্রুপগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে তাদের আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে।
নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের ফলে তাদের কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন ঘটায় তারা নানাভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা করছে। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো তাদের নিজস্ব সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন পত্রিকাতে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর কৌশল নিয়েছে। তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের যমচুগ পাহাড়ে, বনে-জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া ও আশেপাশে এলাকায় গাছপালা কেটে ফেলার অভিযোগ তোলে। তবে, এই অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। বিশেষ সূত্রে জানা যায় যে, এসব অপপ্রচার সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পার্বত্য এলাকার সাধারণ মানুষ জানে, সেনাবাহিনী এ অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করছে। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া এসব মিথ্যা তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানান, এসব অপপ্রচার উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জনমনে ভুল ধারণা তৈরি করার কৌশল। তারা আরও বলেন, সেনাবাহিনী সাজেকসহ বিভিন্ন জায়গায় আগুন নিভানোর দায়িত্ব পালন করছে, তারা কিভাবে পাহাড়ে আগুন লাগাতে পারে? এই অভিযোগ একদম ভিত্তিহীন। সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করে তাদের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান বন্ধ করার জন্যই সন্ত্রাসীরা এ ধরনের মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছে। মূলত, সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো এসব অপপ্রচার চালিয়ে সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান ও উন্নয়নমূলক কাজের বিরুদ্ধে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়।
পার্বত্য এলাকায় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের তৎপরতা ও আধিপত্যবাদী মনোভাবের কারণে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জেএসএস (মূলদল) ও ইউপিডিএফ (মূলদল) এর মধ্যে বিরোধ, সংঘর্ষ, গোলাগুলি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার নতুন কোনো ঘটনা নয়। এরা দীর্ঘদিন ধরেই সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীকে জিম্মি করে রেখেছে। যেকোনো উন্নয়ন কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। তারা চাইছে, পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাস ও ভীতি বজায় রেখে সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে। সেনাবাহিনীর টহল জোরদার করার ফলে তাদের কর্মকাণ্ড অনেকটাই সীমিত হয়েছে, যার ফলে তারা এখন অপপ্রচারের আশ্রয় নিয়েছে।
সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী ও সাধারণ জনগণ একসঙ্গে কাজ করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরে আসবে বলে আশাবাদী স্থানীয়রা।