
তিনি আর মাত্র আধা ঘণ্টা বেঁচে থাকবেন, মৃত্যুদূত তার সামনে। মরণকালে চোখে ভাসছে মায়ের ছবি-দেশের ছবি। ভাগ্যের অন্বেষণে ইতালি যেতে না পারার দুঃখ এখন বড় নয়, বেঁচে থাকার সামান্য নিশ্চই নেই। এমন মৃত্যুপথযাত্রী এবং লিবিয়ায় দালালচক্রের হাতে বন্দী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাসেল ভাবছিলেন, মাকে শান্তি দিতে না পারার ব্যর্থতা বিষয়ে। মাকে জীবনের শেষ আকুতির কথা জানালেন -‘আম্মা আমারে মাফ করছোনি, আর আধা ঘণ্টা বাঁচুম’।সন্তানের জীবনের এমন শেষ আকুতি কীভাবে সইতে পারেন মা! একটা সুস্থ-সবল মানুষের মুখে নিজের আসন্ন মৃত্যুসংবাদ কাউকে না কাঁদিয়ে কি পারে?
এমন নিষ্ঠুর কাণ্ডের কারণ, জঘন্য মনোবৃত্তির মানবপাচারকারী চক্রের হিংস্র-পশুসুলভ মানসিকতা। ঘটনাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার রাসেল মিয়া নামের ইতালি অভিবাসন প্রত্যাশী এক তরুণের। পৈতৃক ঘরবাড়ি বিক্রি করে ১৫লাখ টাকার বিনিময়ে যিনি ইতালি প্রবাসী হতে চেয়েছিলেন। আশা ছিল পরিবারের মুখে হাসি ফুটাবেন। সংসারের অসচ্ছলতা দূর করে নিজেও সুখের জীবন পাবেন। কিন্তু বিধি বাম। দালালরা তাকে নিয়ে যায় লিবিয়া। ওখানে তিনি বন্দী হয়ে পড়েন মানব দালালচক্রের হাতে। তারা রাসেল মিয়াকে জিম্মি করে তার পরিবার থেকে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে নেয়। তারপরও মুক্তি দেয়নি তাকে। আরও টাকা চাই ওদের। আরও চাই ১০ লাখ। দরিদ্র রাসেলের পরিবার কোথায় পাবে টাকা? পাষণ্ড দালালচক্র ১০ লাখ টাকা আদায়ের জন্য অমানসিক নির্যাতন চালায় তার ওপর। মা জানলেন,তার সন্তান নরপশুদের অত্যাচারে জীবনবিপন্ন অবস্থায়। দূরদেশে এমন মৃত্যুর দুয়ার থেকে কীভাবে ফিরিয়ে আনবেন তার বুকের ধনকে। মায়ের আকুতি শুনেনি ঘাতকেরা। রাসেলের শরীরে বিষাক্ত ইনজেকশন প্রয়োগ করে পাষণ্ডের দল। সবশেষে ২১ ফেব্রুয়ারি রাসেল মৃত্যুর কাছে হার মানেন।
একজন রাসেলই যদি এমন ভয়ংকর মৃত্যুমুখে পড়তেন তাও মেনে নেয়া কঠিন ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রায়ই এমন রাসেলদের লিবিয়ায় মৃত্যুকূপে ঝাঁপ দিতে দেখা যায়। ইউরোপে চাকরির আশায় তারা লিবিয়াকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে বেছে নেন স্থানীয় পাচারকারীচক্রের মাধ্যমে। আর সেখানেই তাদের জিম্মি হতে হয়,কারো কারো পরিণতি হয় রাসেল এর মতো।
ইউরোপে যাওয়ার আশায় যারা দেশ ছাড়েন, তাদের প্রায় সবাই লিবিয়ায় এমন চক্রের হাতে বন্দী হয়। তাদের জিম্মি করে দেশ থেকে পণ আদায় করে ওই দালালরা। সেই কাজে সহযোগিতা করে এদেশীয় কিছু দুষ্টচক্র। শুধু লিবিয়াতেই মৃত্যুফাঁদে পড়ে তা নয়,তাদের অনেকে আবার ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবিতে সাগরেই প্রাণ হারায়। পত্রপত্রিকায় সংবাদ হয়। মাঝে মধ্যে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দুয়েকটি বাক্যব্যয়ও করেন। কিন্তু এই মৃত্যুযাত্রা থামে না। কঠোর পদক্ষেপ না নিলে এই মরণমিছিল সহসাই বন্ধ হবে এমনটাও হতে পারে না।
অবাক করা একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০২৪ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। জানা যায়, ২০১১ থেকে ২০২৪ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লিবিয়ায় আটকে থাকা ইউরোপগামী ৪৩ হাজার বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে বাংলাদেশ সরকার। সেই হিসাবে প্রতিবছর ৩ হাজারের বেশি অবৈধভাবে ইউরোপগামীকে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে।
যে-সব মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশ যেতে চায় তাদের কতভাগ মানুষ যাচাইয়ের মতো কাজটি করতে পারবে? তারা সেই প্রতারক আদম ব্যাপারীদেরই দায়িত্ব দেবে। যাকে শিয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। যেহেতু বিদেশগামীদের পক্ষে যাচাই করা সম্ভব নয় তাই সরকারকে এর দায়িত্ব নিতে হবে।
কিন্তু প্রায়ই অবৈধপথে ইউরোপগামী বাংলাদেশিদের ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে প্রাণহারানোর সংবাদ হয়। পৃথিবীর অন্যদেশ থেকেও অবৈধপথে ইউরোপ যাওয়ার তথ্য আছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে এই সংখ্যা অনেক। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টাকারীদের মধ্যে বাংলাদেশিদের অবস্থান তৃতীয়।
অকল্পনীয় একটি চিত্র ফুটে ওঠে আরেকটি পরিসংখ্যানে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২০২৪ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশি অভিবাসীদের ৮৪জনের মৃতদেহ বাংলাদেশে আনা হয়েছে। যাদের কেউ কেউ এভাবে জিম্মি অবস্থায় কিংবা ইউরোপ যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে প্রাণ হারিয়েছেন।
সাধারণত লিবিয়া,আলজেরিয়া ও মৌরিতানিয়া হয়ে অবৈধভাবে ইউরোপ যায় ভাগ্যান্বেষী মানুষগুলো। কেউ কেউ সফল হয়। আর এই সাফল্যকে পুঁজি করে দুষ্টচক্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যথাক্রমে ইমু,ফেসবুক,হোয়াট্স আ্যাপ ব্যবহার করে তারা। পুলসিরাত পাড়ি দিয়ে যারা অভীষ্ট্য গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে তাদের পরবর্তী লড়াইর প্রসঙ্গ না হয় না বলাই থাকলো। কিন্তু যারা পৌঁছতে পারে না তাদের অবস্থাটা কী? একেকটি পরিবার পথের ভিখারী হয়ে পড়ে। কেউ কেউ রাসেলের মতো প্রিয়জনকে হারায়।
প্রশ্ন হচ্ছে,এই মরণখেলা বন্ধ করার জন্য কোনো পদক্ষেপই নেয়া যায় না? লিবিয়া থেকে কিংবা মাঝপথের অন্য কোনো দেশ থেকে এই পর্যন্ত বহু অভিবাসনপ্রত্যাশী দেশে ফিরেছে। বিশেষ করে যে ৪৩ হাজার মানুষকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে,তাদের কাছে বিস্তারিত তথ্য আছে। তারা জানে কারা এই অমানবিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। কোন আদম ব্যাপারীকে আইনের আওতায় আনতে হবে সেরকম উদ্যোগ নিতে চাইলে এই ৪৩ হাজার হতভাগার সাক্ষ্যই যথেষ্ট বলে মনে করি। বাস্তবতা হচ্ছে,অবৈধপথে বিদেশগামীর সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। এই যে ৪৩ হাজার মানুষকে দেশে ফিরিয়ে আনা হলো, তাদের প্রত্যাবাসন ব্যয় বিভিন্ন দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া গেলেও বাংলাদেশেরও টাকা খরচ হয়েছে। এবং এর পরিমাণও যে কম হবে না তা সহজেই অনুমান করা যায়। অসৎ আদম ব্যাপারীগুলোকে আইনের আওতায় আনতে কি সেই পরিমাণ টাকা খরচ হবে? বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারগুলোর নির্লিপ্ততাই মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে। আসতে পারে সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সম্পর্কেও। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই প্রবাসীদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষার জন্য তারা যে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে ব্যর্থ তা বলা বোধ করি বেশি হবে না। তাদের কাজ কি লাশ বহনকারী গাড়ির মতো? বিদেশগামীদের ভিসা যাচাইয়ের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়। এই কাজটি সরকারকে নিজ দায়িত্বে সম্পন্ন করে দেওয়া উচিত। যে-সব মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশ যেতে চায় তাদের কতভাগ মানুষ যাচাইয়ের মতো কাজটি করতে পারবে? তারা সেই প্রতারক আদম ব্যাপারীদেরই দায়িত্ব দেবে। যাকে শিয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। যেহেতু বিদেশগামীদের পক্ষে যাচাই করা সম্ভব নয় তাই সরকারকে এর দায়িত্ব নিতে হবে।
যে-সব দেশকে প্রতারকরা ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসকেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে এই বিষয়ে তারা আলোচনা করতে পারে। প্রয়োজনে আইনী ব্যবস্থা নিতে পারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে। প্রতারক মানবপাচারকারীদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। অবশ্যই মনে রাখতে হবে রাসেলের মতো আর কোনো প্রাণহানী যেন না ঘটে। শুধু প্রাণরক্ষাই নয় এরা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বাড়বে, সমৃদ্ধির পথেও তারা ভূমিকা রাখবে। সরকারকে ভাবতে হবে- এই বিদেশগামী মানুষগুলো সর্বোচ্চ নিরাপত্তার বিষয়ে। মৃত্যুক্ষণ জানা আর কোনো মানুষের সংবাদ যেন আমাদের দেখতে না হয় সেটুকু প্রত্যাশা করতেই পারি।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/এএসএম