
১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস নির্ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে জারি করা সংশোধিত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল আবেদনের ওপর শুনানির জন্য ১২ মার্চ দিন ঠিক করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
শুনানিতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগকে জানিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। অ্যাটর্নি জেনারেলের শুনানির পরে এ বিষয়ে আরও শুনানির জন্য আগামী ১২ মার্চ দিন ঠিক করেছেন আপিল বিভাগ।
মঙ্গলবার (৪ মার্চ) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বিচারপতির আপিল বিভাগের বেঞ্চ তিনি এ কথা বলেন। পরে আরও শুনানির দিন ঠিক করেন আপিল বিভাগ।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এই রায়ে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। রায়ে শেখ মুজিবকে গ্লোরিফাই করা হয়েছে অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। পরে আপিল বিভাগ মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স নিয়ে ফের আপিল শুনানির জন্য ১২ মার্চ দিন ধার্য করেন।
এর আগে মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তিনটি গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এসব গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে ১৩ বছর এবং সর্বশেষ গেজেটটিতে ১২ বছর ৬ মাস বয়স নির্ধারণ করা হয়।
পরে এসব গেজেটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৫টি রিট দায়ের করা হয়। সেই রিটের পর জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গত ১৯ মে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন।
ওই রায়ে মুক্তিযোদ্ধা হতে বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস নির্ধারণ করে জারি করা গেজেট ও আইনের ধারা অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এ রায়ে হাইকোর্ট বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যাবে না।’ এ রায় স্থগিত চেয়ে চেম্বার আদালতে যায় রাষ্ট্রপক্ষে কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সেই রায় স্থগিত করেন চেম্বার জজ আদালত ও আপিল বিভাগ।
২০১৯ সালের ১৯ মে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স নির্ধারণীর বিষয়ে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না।’
পৃথক পৃথক ১৫টি রিটের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায় ঘোষণার সময় রোববার হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এমন পর্যবেক্ষণ দেন।
১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস নির্ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জারি করা সংশোধিত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে, ২০১৪ সালের এবং ২০১৬ সালের গেজেট ও পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেছেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেসুর রহমান জাগো নিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
এর আগে ২০১৮ সালের বিভিন্ন সময় একাধিক রিটের শুনানি নিয়ে ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স ১২ বছর ৬ মাস নির্ধারণ করে জারি করা পরিপত্র কেন আইনগত কর্তৃত্ব-বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযোদ্ধা সচিব, যুগ্ম সচিব, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, অর্থসচিব, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালককে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের পরিচালক মাহমুদ হাসানের করা রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই হাইকোর্টের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
এর আগে এই রিটের শুনানি করেছিলেন ব্যারিস্টার এ বি এম আলতাফ হোসেন। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী এ আর এম কামরুজ্জামান কাকন ও শুভ্রজিৎ ব্যানার্জি। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল।
রিটকারী আইনজীবী কামরুজ্জামান কাকন তখন সাংবাদিকদের বলেন, বাদী মাহমুদ হাসান ১৯৮৮ সালের ২৬ জুন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরে যোগ দেন। জন্মতারিখ অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর তার বয়স হয় ১২ বছর ৪ মাস ১২ দিন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর গত ২ মার্চ এক অফিস আদেশে বাদীকে বলেন, ‘১৭ জুলাই তার বয়স ৫৯ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। সরকারিবিধি অনুযায়ী, ১৮ জুলাই থেকে তার অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) শুরু হবে। এ অবস্থায় ছুটি ভোগ করতে চাইলে তাকে আবেদন করতে হবে।’
পরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ এক অফিস আদেশে জানায়, গত ১৭ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স ১২ বছর ছয় মাস নির্ধারণ করে যে সংশোধিত পরিপত্র জারি করে তার সঙ্গে বাদীর বয়স সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
আইনজীবী কামরুজ্জামান কাকন আরও বলেন, ‘পাবলিক সার্ভেন্টস (রিটায়ারমেন্ট) অ্যাক্ট-১৯৭৪, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ৬০ বছর পর্যন্ত তার চাকরির মেয়াদ থাকার কথা। ফলে, তার প্রতি যে অফিস আদেশ দেওয়া হয়েছে তা স্পষ্টতই এ আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যে কারণে তিনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জারি করা গেজেট, সংশোধিত পরিপত্র ও অফিস আদেশটি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। সেটির ওপর শুনানি শেষে আদালত রুল জারির পাশাপাশি অফিস আদেশটির কার্যকারিতা ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন।’
২০১৬ সালে প্রথমে এক গেজেট জারি করে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স হতে হবে ১৩ বছর। এরপর গত ১৭ জানুয়ারি একটা পরিপত্রের মাধ্যমে সেই গেজেট সংশোধন করে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স হতে হবে ১২ বছর ৬ মাস।
আইনজীবী আলতাফ হোসেন বলেন, পাবলিক সার্ভেন্টস (রিটায়ারমেন্ট) অ্যাক্ট-১৯৭৪ অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার ৬০ বছর পর্যন্ত চাকরির সুযোগ পাওয়ার কথা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করে দেওয়ায় সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে যা পাবলিক সার্ভেন্টস (রিটায়ারমেন্ট) অ্যাক্ট-১৯৭৪ এর ৪(এ) ধারা এবং সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর এক সপ্তাহ আগে হাইকোর্টে রিটটি করা হয়। আদালত রিটের শুনানি নিয়ে রুল ও স্থগিতাদেশ জারি করেন।
এফএইচ/এমআরএম/জিকেএস