Status

মব তৈরি করছে আতঙ্ক-উদ্বেগ

ঢাকাসহ সারাদেশে ‘মব জাস্টিসের’ নামে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার ঘটনা থামছেই না। মঙ্গলবার গভীর রাতে ঢাকার গুলশানের ডিপ্লোম্যাটিক জোনের মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ ও নিরাপদ এলাকায় বাসার সাবেক কেয়ারটেকারের নেতৃত্বে মব তৈরি করে এক ব্যবসায়ীর বাসায় লুটপাট করা হয়। এক পর্যায়ে জড়িতরা পুলিশ, র‌্যাব ও সেনা সদস্যদের সামনেই চলে যায়।

 

দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে মব তৈরি করে একের পর এক লুটপাট, হত্যা, নির্যাতন, মারধর, লাঞ্ছনা, অপমান, অপদস্থ ও হামলা করার ঘটনা ঘটছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায়। যদিও গুলশানের ঘটনায় সাবেক কেয়ারটেকার শাকিল আহমেদসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মব জাস্টিসের নামে বেআইনি নির্যাতন, গণপিটুনি ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা রোধে ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিটও করা হয়েছে। রিটে মব জাস্টিস তথা উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে বিচার বা হত্যা বা নির্যাতন রোধে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা চাওয়া হয়। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তথাকথিত মব জাস্টিসের নামে হামলা ও হত্যার হার অনেক বেড়ে যায়। তারই ধারাবাহিকতায় এখন আবার শুরু হয়েছে গণপিটুনিতে হত্যা ও লুটপাট।

 

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মব তৈরির মাধ্যমে লুটপাট, নির্যাতন, মারধর, লাঞ্ছনা, হামলার ঘটনা অসংখ্য। একের পর এক ঘটনায় দেশে নতুন আতঙ্ক ও উদ্বেগ তৈরি করেছে মব জাস্টিস। অন্তর্বতী সরকারের হুঁশিয়ারিও আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার রোধ করতে পারছে না। এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া ব্যক্তিদের কঠোর বিচার হওয়া দরকার। হঠাৎ করেই মব সৃষ্টি হয়। তাই নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সুযোগসন্ধানী এবং অপরাধীরা নানা গুজব রটিয়ে মব সৃষ্টি করছে। যারা মব সৃষ্টি ও গণপিটুনির ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।

 

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগীরা দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করতে মব তৈরির মাধ্যমে নানা অপরাধ করছে। মবের সাথে জড়িতরা সারাদেশের পাশাপাশি দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকা ডিপ্লোম্যাটিক জোনেও হামলা-লুটপাট করছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও এদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা মন্তব্য করেন।

 

পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার ঘটনায় ৫ আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি নিহত হয়েছে। মারধর, নির্যাতন, লাঞ্ছনার ঘটনার সঠিক সংখ্যা নেই। দেশের কোথাও না কোথাও এমন ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘মব তৈরির’ করে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা আউটার রিং রোডে চেকপোস্টে দায়িত্বরত এসআই ইউসুফ আলীর ওপর হামলা করা হয়। হামলাকারীরা তার মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ এবং ওয়াকিটকি ছিনিয়ে নেয়। খবর পেয়ে সৈকত এলাকায় টহলরত পতেঙ্গা থানা পুলিশের একটি দল ও আশপাশের লোকজন গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। মব তৈরি করে পুলিশের ওপর হামলা চালানোর ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ১২ জনকে আটক করা হয়েছে।

 

পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় মঙ্গলবার সতর্কতা জারি করে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘মবের প্রতিটি ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর।’ তবে সম্প্রতিক সময়ে গণপিটুনির সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি শরিয়তপুরে। সেখানে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন। পুলিশ জানায়, ওইদিন রাতে মাদারীপুরের রাজারচর এলাকায় বাল্কহেডে ডাকাতির চেষ্টা করে ডাকাতরা। স্থানীয়রা তাদের ধাওয়া করে। ডাকাতরা শরিয়তপুরের তেঁতুলিয়া এলাকায় গেলে স্থানীয়রা নদীতে বাল্কহেড দিয়ে তাদের গতিপথ রোধ করে।

 

এসময় ডাকাতরা হাতবোমা ও এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়লে গুলিতে আহত হন চারজন। পরে ডাকাতরা স্পিডবোট ফেলে পালানোর চেষ্টা করলে সাতজনকে আটক করে গণপিটুনি দেয়া হয়। ওই সাতজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার পর চারজন মারা যায়। পরে আরেকজনের লাশ নদীতে ভেসে ওঠে। এর আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীতেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। উত্তরায় ছিনতাই কারী সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে পায়ে দঁড়ি বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। উত্তরার হাউজ বিল্ডিংয়ের বিএনএস সেন্টারের সামনে ফুটওভার ব্রিজের ওপরে এ ঘটনা ঘটে।

 

মব জাস্টিসে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ.বি.এম নাজমুস সাকিব ইনকিলাবকে বলেন, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অধিকার বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় কাউকে দেয়া হয়নি। ৫ আগস্টের হঠাৎ পরিবর্তন বাংলাদেশের সমাজে নতুন করে এক ধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলার উদ্ভব ঘটিয়েছে যা ‘মব জাস্টিস’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার রয়েছে এবং আইনের শাসন কায়েম করা তাদের উপর বর্তায়। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি কিছু গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা এবং বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে নিজেরাই আইন প্রয়োগ করার কাজে লিপ্ত হচ্ছে। কোন কোন গোষ্ঠী এই সুযোগে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার পাঁয়তারা করছে।

 

তিনি আরও বলেন, একদিকে যেমন বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা মবকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করেছে এবং অন্যদিকে নতুন পরিবর্তন এর ফলে ভিন্নমতকে অগ্রাহ্য করার এক ধরনের তাড়না তাদের মধ্যে লক্ষণীয়। তবে এভাবে ভিন্নমতকে পেশীর জোরে নিষ্পেষিত করার প্রচেষ্টা চলমান থাকলে সেটা সমাজে যেমন কোন ভালো ফলাফল বয়ে আনবে না, তেমনি আদিম সমাজের ‘রিভেঞ্জ থিওরি’তে ফিরে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হতে পারে। ভবিষ্যত বাংলাদেশের জন্যে যেটা খুবই আশঙ্কার এবং দুশ্চিন্তার। সরকারের উচিত এই বিষয়ে জনগণকে স্পষ্ট বার্তা প্রদান করা এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।

 

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, মব জাস্টিস কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার সুযোগ কারো নাই। যদি অপরাধীও হয়, তাকে পুলিশের হাতে দিতে হবে। যারা মব জাস্টিসে জড়াচ্ছেন, তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছেন। মব জাস্টিসে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ বিষয়ে সারাদেশে পুলিশ কাজ করছে।

 

গুলশানে মব তৈরি করে লুটপাটের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩ জন কারাগারে: বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ, অস্ত্র ও আওয়ামী লীগের দোসরদের লুকিয়ে রাখা হয়েছে; এমন অভিযোগে সাবেক পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের ছেলে সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর বাসায় ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত তখন ১২টা। গুলশান-২ এর ৮১ নম্বর সড়কের ওই বাড়িতে প্রবেশের চেষ্টা করে কতিপয় ছাত্র জনতা।

 

এ সময় বাড়ির দারোয়ান গেট খুলতে না চাইলে ওই বাড়িরই এক সময়ের কেয়ারটেকার শাকিলের নেতৃত্বে জনাবিশেক লোক মেইন গেট টপকে বাসার দরজা ভেঙে ফেলে। এরপর তারা বাসাটির প্রতিটি কক্ষে তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চালায়। এর আগে শাকিল বলেছিলো বাসাটিতে আ’লীগের অনেক দোসরকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি পাচারের উদ্দেশ্যে দুই-তিনশ’ কোটি টাকা জমা রাখা আছে। রয়েছে অবৈধ অস্ত্র এবং অবৈধ মাদক। কিন্তু ছাত্র জনতা তল্লাশি চালিয়ে সেখান থেকে কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি। এর আগের রাতেও জনতা বাড়িটিতে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশ এসে তাদের সরিয়ে দেয়।

 

মঙ্গলবার রাতেও ছাত্র জনতা বাড়িটিতে প্রবেশের চেষ্টা করে অনেক সময় ধরে। কিন্তু হামলাকারীরা চলে যাবার পর পুলিশ যায়। জানা গেছে, ৯৯৯ এর মাধ্যমে খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১২টায় ঘটনাস্থলে আসে গুলশান জোনের ডিসি, গুলশান থানার ওসি’সহ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এ সময় লুটপাটের অভিযোগে ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গতকাল তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। এরা হলেন, শাকিল খন্দকার (২৪), জুয়েল খন্দকার (৪৮) এবং সাবেক কেয়ারটেকার শাকিল আহমেদ (২৮)। জুয়েল খন্দকার ও শাকিল খন্দকার সম্পর্কে বাবা-ছেলে। গতকাল তাদের আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

Source link

Leave a Reply

Back to top button