ভ্রাতৃত্বের চর্চায় আলোকিত হোক আমাদের সমাজ-২

একটি দেয়ালের সবগুলো ইট মিলেই তা গড়ে ওঠে। প্রতিটি ইটই ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু দেয়ালের অস্তিত্বের জন্যে ইটগুলোর সম্মিলন অপরিহার্য। একটি ইটের উপর স্থাপিত হয় আরেকটি ইট, সেটার উপর আরো একটি। ইট গাঁথা হয় পাশাপাশিও। এভাবেই গড়ে ওঠে একেকটি দেয়াল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একেকটি ইট দিয়ে তৈরি হয় বড় বড় প্রাসাদ। রাসূলুল্লাহ (সা.) এই ইটের সঙ্গেই মুমিনদের তুলনা করেছেন। ইট যেমন একে অন্যকে সহযোগিতা করে, মুমিনরাও একে অন্যের পাশে দাঁড়ায় সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায়।

এই সহযোগিতার ওপর ভর করেই গড়ে ওঠে ঈমানী ভ্রাতৃত্ব, মুমিনদের সমাজ। ভ্রাতৃত্বের এই শিক্ষা ছড়িয়ে আছে মুমিনের পদে পদে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতে প্রতিদিনই সে উপস্থিত হয় মসজিদে। ধনী-গরিব আপন-পরের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দৈনিক এভাবে পাঁচবার একই কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যায় তারা। জীবনের অন্য সব ক্ষেত্রে ভ্রাতৃত্বকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে এই একটি আমলের শিক্ষাই তো যথেষ্ঠ হওয়ার কথা। একই শিক্ষা পাওয়া যায় ঈদের উৎসবে এবং হজ্বের ময়দানে। লক্ষ লক্ষ মুসলমান গায়ে দুটি সাদা চাদর জড়িয়ে এক প্রভুর আহ্বানে হাজির। সবার লক্ষ্য এক, মুখেও সবার একই উচ্চারণ- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক…।
ঈদুল আযহায় আবার ভ্রাতৃত্ব রক্ষার ধরনটা ভিন্ন। যাদের সামর্থ্য আছে তারাই তো ঈদে পশু কুরবানী করে। নিজের টাকায় কেনা পশু নিজ হাতে কুরবানী করার পর এর কিছু অংশ নিজের ঘরে রেখে দেয়, কিছু বিলিয়ে দেয় আত্মীয়-স্বজন আর পড়শীদের মাঝে, আর কিছু দেয় গরিব ও অসচ্ছলদেরকে, যাদের কুরবানী করার সামর্থ্য ছিল না। ফলে সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও ঈদ ও কুরবানীর আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয় না তারা। এভাবেই পূর্ণ হয় ঈমানী ভ্রাতৃত্বের দাবি।

ঈমানী এই ভ্রাতৃত্ব কীভাবে রক্ষা করতে হবে, মুমিনের পাশে মুমিনকে কীভাবে দাঁড়াতে হবে এর কিছু নমুনাও বলে দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। লক্ষ্য করুনÑ ‘ঈমানদারদের সঙ্গে একজন মুমিনের সম্পর্ক ঠিক তেমন, যেমন সম্পর্ক দেহের সঙ্গে মাথার। ঈমানদারদের দুঃখ-কষ্ট ঠিক সেভাবেই সে অনুভব করে, যেমন মাথা দেহের ব্যথা অনুভব করে।’ (মুসনাদে আহমাদÑ২২৮৭৭)

ঈমানের এ বন্ধনকে রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো দেশ গোত্র ভাষা কিংবা সময়ের ফ্রেমে আটকে দেননি। তাঁর নির্দেশনা এসব সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে ছড়িয়ে আছে বহুদূর পর্যন্ত। তাই তো দূর কোনো দেশের কোনো মুসলমান ভাইয়ের কষ্টকর কোনো সংবাদে অন্য মুসলমানগণ ব্যথিত হন। যথাসম্ভব সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। এই ব্যথা এই কষ্ট আর এই সহযোগিতা ঈমানের দাবি।

ভ্রাতৃত্বের এই দাবি মেটাতে গিয়ে মুমিন তার সবটুকু সাধ্য ব্যয় করবে। সময়ের চাহিদা বুঝে সে এগিয়ে আসবে। মুমিনের পাশে মুমিন থাকবেই। কখনো অর্থ দিয়ে, কখনো পরামর্শ দিয়ে, কখনো প্রয়োজন হলে শুধুই সঙ্গ দিয়ে সে তাকে সহযোগিতা করবে। বিপদের মুহূর্তে পাশে এসে কিছুক্ষণ বসে সান্ত¡নার বাণী শোনালেও মানসিক শক্তি বেড়ে যায় অনেক। সঙ্গত কারণেই ভ্রাতৃত্বের এই বন্ধন রক্ষা করার ফযীলতও খুবই ঈর্ষণীয়। নবীজী (সা.) বলেছেন, যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূর্ণ করে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করে দেন। (সহিহ বুখারী-২৪৪২)

নবীজী (সা.)-কে বলা হয় ‘আসসাদিকুল মাসদূক’। তিনি সর্বদাই সত্য বলেছেন। তিনি এখানে আমাদেরকে কথা দিচ্ছেন- কেউ তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে দিলে আল্লাহও তার প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন। এই প্রতিশ্রুতির পর আর কী চাই আমরা! সহযোগিতা বলতে আমরা বুঝি কেবলই বিপদে পাশে দাঁড়ানোকে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গ-িকে আরো অনেক বিস্তৃত করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য করো, সে জালিম হোক কিংবা মজলুম হোক। সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ! মজলুমকে তো আমরা সাহায্য করব। কিন্তু জালিমকে কী করে সাহায্য করব? তিনি বললেন, তাকে তার জুলুম থেকে বাধা দেবে। (সহিহ বুখারী-২৪৪৪)

এই হাদিসে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। এক. মুমিন সকলেই একে অন্যের ভাই। এই ভ্রাতৃত্ব সর্বাবস্থায়ই সত্য। একজন মুমিন শয়তানের ধোঁকায় পড়ে কোনো পাপে জড়িয়ে পড়তে পারে, অন্যায়ভাবে কারো ওপর হাত ওঠাতে পারে। এসবই অপরাধ, কিন্তু এতে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বাতিল হয়ে যায় না। তাই তো হাদিসে মজলুমকে যেমন ভাই বলা হচ্ছে, জালিমকেও একইসঙ্গে ভাই বলেই উপস্থাপন করা হচ্ছে।

দুই. জালিমকে তার জুলুম থেকে ফিরিয়ে রাখাটাই তার জন্যে সহযোগিতা। অন্যায় ও জুলুমে লিপ্ত হয়ে সে জাহান্নামের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। সে পথ থেকে তাকে ফিরিয়ে ন্যায় ও কল্যাণের পথে তুলে আনাটাই তার জন্যে প্রকৃত সহযোগিতা। হাদিসে এই সহযোগিতার কথাই বলা হচ্ছে- তোমার ভাই যদি জুলুম করে তাহলে তার হাত ধরে তাকে জুলুম থেকে বাধা দাও।

Source link

Exit mobile version