বিদায় ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’

ভারতের ছিল একটি ওয়াল। ‘দ্য ওয়াল’ নামে পরিচিত সেই ক্রিকেটার ভারতের অনেক সাফল্যের সঙ্গী। উইকেটে নামলে তাকে আউট করা ছিল কঠিন। প্রতিপক্ষের বোলারদের রীতিমত ঘাম ছুটে যেতো তার উইকেটটি পেতে। যে কারণে রাহুল দ্রাবিড়ের নাম হয়ে গিয়েছিলো দ্য ওয়াল।
বাংলাদেশে দ্য ওয়াল ছিলেন না হয়তো, তবে ভরসা করার মতো একটি নাম ছিল। ছিল বলতে হচ্ছে, কারণ- আজ (৫ মার্চ, বুধবার) রাতে ফেসবুকে দেওয়া এক দীর্ঘ স্ট্যাটাসে ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ভরসা করার মতো সেই নামটি ছিল মুশফিকুর রহিম। ক্রিকেটাঙ্গনে যাকে বলা হতো ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল।’
২০০৬ সালের ৬ আগস্ট হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হয় মুশফিকুর রহিমের। দলের অধিনায়ক তখন খালেদ মাসুদ পাইলট। উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতেও তখন তিনি তুমুল জনপ্রিয়। মুশফিকের সামনে সহজ ছিল না পাইলটের এই জায়গাটা দখল করার।
ব্যাটার হিসেবে ব্যাট করারও সুযোগ পেতেন না শুরুর দিকে। প্রথম চার ম্যাচের মাত্র একটিতে ব্যাট করতে পেরেছিলেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে। রান করতে পেরেছিলেন মাত্র ১৮। তাও ছিলেন অপরাজিত। প্রথম হাফ সেঞ্চুরি, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০০৭ এর ফেব্রুয়ারিতে।
ক্যারিয়ারের প্রথম ৯ ওয়ানডের ৭টিই খেলেছেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। বাকি দুটি স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। ২০০৭ বিশ্বকাপের আগে বড় কোনো দলের বিপক্ষে খেলারই সুযোগ পাননি তখন সদ্য কৈশোর পেরুনো ছোট শরীরের মুশফিকুর রহিম। যদিও তার আগে টেস্টে বেশ দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন। ২০০৫ সালে আলোচিত ইংল্যান্ড সফরে লর্ডসে সর্বকনিষ্ট ক্রিকেটার হিসেবে খেলতে নেমেছিলেন।
মুশফিক যে কী ধরনের ব্যাটার, তার ভেতর কী রয়েছে সে পরিচয় দেন ২০০৭ বিশ্বকাপে। খালেদ মাসুদ পাইলটের পরিবর্তে তরুণ উইকেটরক্ষক মুশফিককে বেছে নিয়েছিলো নির্বাচকরা। প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে খেলতে নেমে উইকেটের পেছনে দাঁড়ালেন। আবদুর রাজ্জাকের বলে শচিন টেন্ডুলকার (৭) এবং মাশরাফির বলে অজিত আগারকারের (০) ক্যাচ ধরেন মুশফিক।
১৯২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামার পর তামমের ব্যাটে উড়ন্ত সূচনা। ২ রান করে শাহরিয়ার নাফীস আউট হয়ে যাওয়ার পর ওয়ান ডাউনে দৃঢ়তাপূর্ণ এক ইনিংস খেলেন মুশফিক। ১০৭ বলে করেন অপরাজিত ৫৬ রান। তার ওই ইনিংসটিই জয়ের ভিত গড়ে দেয়। সঙ্গে তামিমের মারকুটে ৫১ এবং সাকিবের দায়িত্বশীল ৫৩ রানে ভর করে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ। মোহাম্মদ আশরাফুলের সঙ্গে বিজয়ীর বেশে সাজঘরে ফেরেন মুশফিক।
দলের মধ্যে নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ওঠা সেই শুরু। এরপর ধীরে ধীরে বিপদের মুহূর্তে মুশফিক নিজেকে উপস্থাপন করেন একজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটার হিসেবে। দল খুব খারাপ খেলছে, মিডল অর্ডারে কারও হাল ধরার দরকার, মুশফিক সেখানে ভূমিকা পালন করেছেন। এমন অসংখ্য নজির রয়েছে। স্পিন বোলিংয়ের বিপক্ষে সবচেয়ে কার্যকর ব্যাটার হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছেন তিনি।
২০১৮ এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একের পর এক উইকেট হারাতে শুরু করে বাংলাদেশ। ২ রানে পড়ে ৩ উইকেট। সেখান থেকে মোহাম্মদ মিঠুনকে নিয়ে ১৩২ রানের জুটি গড়ে ঘুরে দাঁড়ান মুশফিক। ক্যারিয়ার সেরা ১৪৪ রান করেন তিনি। মিঠুন করেন ৬৩ রান।
বাংলাদেশ অলআউট হয়েছিলো ২৬১ রানে। পরে বোলারদের দৃঢ়তায় শ্রীলঙ্কা অলআউট ১২৪ রানে। বাংলাদেশ ম্যাচ জিতে যায় ১৩৭ রানে। এমন লিখতে গেলে অসংখ্য ইনিংস রয়েছে তার। অবশেষে ১৯ বছরে ওয়ানডেতে দীর্ঘ ক্যারিয়ার শেষের ঘোষণা দিলেন মুশফিক। ওয়ানডে থেকে অবসর নিলেন তিনি। ২০২২ সালের অক্টোবরে এমনই এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের নিয়েছিলেন। এবার নিলেন ওয়ানডে থেকে। এখন শুধু টেস্ট ক্রিকেট খেলে যাবেন তিনি।
২০০৬ সালের ডিসেম্বরে হারারে থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি- গত ১৯ বছরে সব মিলিয়ে ২৭৪টি ওয়ানডে খেলেছেন মুশফিকুর রহিম। ৩৬.৪২ গড়ে এবং ৭৯.৭০ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন ৭৭৭৯৫টি। সেঞ্চুরি করেছেন ৯টি এবং হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে ৪৯টি। উইকেটের পেছনে ওয়ানডেতে গ্লাভস হাতে ক্যাচ ধরেছেন ২৪৩টি এবং স্ট্যাম্পিং করেছেন ৫৬টি।
রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটাই হয়ে রইলো মুশফিকের শেষ ওয়ানডে ম্যাচ। যদিও ম্যাচটি মাঠে গড়ায়নি। সে হিসেবে একই ভেন্যুতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটিই তার শেষ ম্যাচ।
আইএইচএস/এমআইএইচএস