ফ্যাসিবাদী ষড়যন্ত্রে স্বকীয়তা হারিয়েছে ইবির আল-ফিকহ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ

ইসলামী শরিয়তের সাথে প্রচলিত আইনের সমন্বয়ে শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) আল-ফিকহ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ। ইসলামী শরিয়ত তথা ফিকহের জন্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে আরবীতে পারদর্শী শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হতো বিভাগটিতে। তবে ২০১৮ সালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ফিকহকে একটি বিশেষায়িত বিভাগ থেকে সাধারণ বিভাগে পরিণত করার কুউদ্দেশ্যে আরবী জানার শর্ত বাদ দিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করে। ফলে ওই শিক্ষার্থীরা আইন বিষয়ে পারদর্শী হলেও ফিকহের বিষয়ে কাঙ্খিত বিশ্বমানের পারদর্শিতা অর্জনে পিছিয়ে রয়েছে বলে জানা যায়। এতে বিভাগটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা ।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত আরবী কিংবা ফিকহ বিষয়ে জানা শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হতো। সেসময় ভর্তি পরীক্ষায় আল-ফিকহ সম্পর্কে আলাদা ২০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো। পরবর্তীতে সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. হারুন-উর-রাশিদ আসকারীর আমলে এই ধারা পরিবর্তন করে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য ৪০ টি এবং অন্যান্যদের জন্য ৪০ টি আসন নির্ধারণ করে দেয়। দুই শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত এ ধারা থাকলেও ২০২০-২১ থেকে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত সেই নিয়মও আর টেকে না। এই বিভাগের ভর্তি উন্মুক্ত হয়ে যায় আরবি না জানা শিক্ষার্থীদের জন্যও । বিশেষায়িত বিভাগ থেকে পরিণত হয় এক সাধারণ বিভাগে।
বিভাগটির সূত্রে জানা গেছে, বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স প্রোগ্রাম মিলে প্রায় ২৫০০ নাম্বারের আরবী বিষয়ে পড়ানো হয়। জেনারেল শিক্ষার্থী অর্থাৎ স্কুল-কলেজ ব্যাকগ্রাউন্ড যারা ভর্তি হয় তাদের অধিকাংশ আরবীতে অদক্ষ। এসব বিষয়ে পাস করাই তাদের পক্ষে অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। এটি মানসম্মত গ্র্যাজুয়েট তৈরির ক্ষেত্রে বিরাট একটি অন্তরায়। এদিকে আরবীতে অদক্ষ শিক্ষার্থীরা ভর্তি হওয়ায় বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের আরবীর কোর্সগুলো বাংলায় লেখার সুযোগ দিতে হচ্ছে। ফলে ফিকহের বিষয়ে পারদর্শী হতে পারছেন না তারা।
বিভাগের শিক্ষকরা জানান, এই ধারা থেকে বের হয়ে পূর্বের ধারায় ফিরে যেতে চায় বিভাগটি। যাতে করে আরবী জানা শিক্ষার্থীরা এই বিভাগে ভর্তি হতে পারে। সে লক্ষ্যে বিভাগের একাডেমিক সভায় শুধুমাত্র ২০২৪-২৫ সেশনের জন্য ধর্মতত্ত্বের অধীনে ভর্তি পরীক্ষা নিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যেখানে বিভাগের ৮জন শিক্ষকের মধ্যে ৭জনই এর পক্ষে মতামত দেন। আর বিপক্ষে মতামত দেন একজন।
এ বিষয়ে বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আনোয়ারুল ওহাব বলেন, আমি শুনলাম বিভাগের একাডেমিক সভায় ধর্মতত্ত্ব অনুষদের অধীনে ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওইদিন আমি ঢাকায় ছিলাম বিধায় সভায় উপস্থিত থাকতে পারিনি। বিভাগ যেটি সিদ্ধান্ত নিবে সেটিই কার্যকর হবে।
এদিকে ধর্মতত্ত্ব অনুষদের অধীনে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভাগের শিক্ষার্থীদের একাংশ।
ধর্মতত্ত্ব অনুষদে অধীনে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার বিপক্ষে আল- ফিকহ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী সায়েম আহমেদ বলেন, একটি অনুষদের পরীক্ষা কেন অন্য অনুষদের অধীনে হতে হবে। এতে করে আমাদের আইডেন্টি ক্রাইসিসে ভুগতে হয়। শিক্ষা ব্যবস্থা সবসময় সার্বজনীন হবে, শিক্ষাতে কোন শ্রেণীবিভেদ নেই।
তবে বিভাগটির শিক্ষার্থীদের আরেক অংশের দাবি, ভালোভাবে ফিকহ পড়তে হলে আরবী ভাষা জানা জরুরি। কিন্তু আরবী না জানা সত্ত্বেও বিভাগে ভর্তি করানো হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ইংরেজি জানার শর্ত দেয়া হয় কিন্তু আল ফিকহ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগে আরবী কোর্স থাকলেও ভর্তির ক্ষেত্রে আরবী জানার শর্ত নেই। এতে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে ফিকহের বিষয়গুলো অধ্যয়ন করতে পারছেন না। অনেকেই পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ করে হতাশায় ভুগছেন। আল ফিকহ এনড় লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের সবচেয়ে বেশী সংগতিপূর্ণ বিভাগ। এই বিভাগের স্বকীয়তা রক্ষা করতে হবে।
বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছালেহ আহমদ বলেন, এই বিভাগ আইন অনুষদভুক্ত একটা বিশেষায়িত বিভাগ। এখানে ফিকহ (শরীয়া ল’) এবং কনভেনশনাল ল’ উভয়টাই পড়ানো হয়। যেহেতু ফিকহ বা শরীয়া হচ্ছে আরবী ভাষা সম্পর্কিত সেহেতু এই বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য বা এই বিভাগে অধ্যয়নের সুবিধার্থে আরবী ভাষায় ন্যূনতম জ্ঞান অর্থাৎ আরবী লিখতে জানা এবং পড়তে জানাটা জরুরি। মূল কথা হচ্ছে– ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি কেমন হবে সেটা বিভাগের এখতিয়ারগত ব্যাপার। ধর্মতত্ত্বের অধীনে ভর্তি পরীক্ষা হলে বিভাগ থিওলজি ফ্যাকাল্টিভুক্ত হয়ে যাবে বা সার্টিফিকেটের মান এল.এল.বি/এল.এল.এম থাকবেনা এরকম ধারণা অমূলক।
বিভাগের প্রফেসর ড. আবুবকর মোঃ জাকারিয়া মজুমদার বলেন, বিজ্ঞানে পড়তে হলে যেমন বিজ্ঞানের শর্ত লাগে তেমনি ফিকাহ পড়তে হলে ফিকাহ এর শর্ত লাগবে। ফিকহের কিছু টার্ম আছে যেগুলো জানতে হলে নুন্যতম আরবী জানা অত্যাবশ্যক। তার মানে এই নয় যে শুধু কুরআন পড়তেই পারলেই সে আরবী জানে। আরবী না জানা একজন শিক্ষার্থী হুট করে এসে ফিকহের টার্ম গুলো বুঝবেনা। যেখানে বিগত সময় গুলোতে ফিকহে ভর্তি হতে কিছু শর্ত পূরণ করেই ভর্তি হতে হত। আরবী না জানা শিক্ষার্থীরা এই বিভাগে ভর্তি হয়ে আল-ফিকহ বিভাগের উদ্দেশ্যকে ধ্বংস করেছে। এর পেছনে হাত ছিল ফ্যাসিস্ট সাবেক প্রশাসনের ভিসি ড. রাশিদ আসকারী ও প্রো-ভিসি ড. শাহিনুর রহমানেরা। এখন শিক্ষার্থীরা নিজেরা ভালভাবে পড়াশোনা করতে পারছে না আমরাও পাঠদান করতে গিয়ে অসুবিধায় পড়ছি। আমাদের উপর বিগত ফ্যাসিস্টরা যা চাপিয়ে দিয়েছিল জোর করে। আমরা সেটি থেকে বের হয়ে ২০২৪-২৫ সেশনের জন্য শুধু ধর্মতত্ত্ব অনুষদের অধীনে পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে। যাতে করে আরবী জানা শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারে। যারা এর বিরোধিতা করছে তারা ফ্যাসিস্টের দোসর। আল্লাহ তাদের হেদায়েত দিন।
ধর্মতত্ত্ব অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. আ.ব.ম সিদ্দিকুর রহমান আশ্রাফী বলেন, আমি আল-ফিকহ বিভাগের ভর্তি পরীক্ষা ধর্মতত্ত্ব অনুষদের অধীনে আনায় বিভাগের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। এতে করে আমার মনেহয় বিভাগের শর্ত পূরণ হবে। যদিও বিগত সময় ফ্যাসিস্টরা এটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করেছিল।
বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. নাছির উদ্দীন বলেন, শর্ত পূরণ করার স্বার্থে ধর্মতত্ত্ব অনুষদ ভুক্ত ‘ডি’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তার মানে এই নয় যে আমরা ধর্মতত্ত্ব অনুষদে চলে যাচ্ছি। মানবিক অনুষদের একটি বিভাগও এই অনুষদের অধীনে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে থাকে। তবে অনেকেই বুঝতে না পেরে বিষয় টি অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেটা কাম্য নয়। এদিকে আমরা বিভাগের নামটি পরিবর্তন নিয়েও কাজ চলমান, সেশনজট নিরসনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. এম এয়াকুব আলী বলেন, এ বিষয়ে বিভাগ যা সিদ্ধান্ত নিবে সেটিই বাস্তবায়ন হবে।
উল্লেখ্য, ইসলামী ও প্রচলিত আইনের সমন্বয়ে শিক্ষা প্রদানের কক্ষ্যে ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে আইন ও শরিয়াহ অনুষদের অধীনে আল-ফিক্হ বিভাগ নামে এই বিভাগের যাত্রা শুরু হয়।