ফেনী নদী থেকে ত্রিপুরায় পানি সরবরাহ বন্ধের দাবিতে আইনি নোটিশ

আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছাড়া বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পানি সরবরাহ বন্ধের দাবিতে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ও যৌথ নদী কমিশনের সদস্যকে এ নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) রেজিস্ট্রি ডাকযোগে নোটিশটি পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান।
নোটিশে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এই সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, ‘ভারত সরকার ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম শহরে পানি সরবরাহের জন্য বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক করে পানি নিয়মিতভাবে উত্তোলন করবে।’
‘সমঝোতা স্মারক কোনও আনুষ্ঠানিক চুক্তি নয়। বাংলাদেশ সরকার বিদেশি কোনও রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করতে বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪৫ ও ১৪৫-এ অনুচ্ছেদ অনুসরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশি কোনও রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি রাষ্ট্রপতির কাছে উত্থাপন করতে হবে এবং সংসদের বৈঠকে পেশ করতে হবে।‘‘কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই, ভারতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছাড়াই বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে— যা আমাদের সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এমনকি, ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ভারতে পানি সরবরাহের বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পাবে না। যেকোনও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো— সেখানে অবশ্যই ‘বিনিময়’ থাকবে। কিন্তু ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পানি সরবরাহের বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পাবে না।’’‘এখানে আরও দুঃখজনক বিষয় হলো, এই সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে ভারত সরকারকে বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ভারত সরকার তাদের নিজস্ব পাম্প দিয়ে বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলন করবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, যদিও সমঝোতা স্মারকে ১.৮২ কিউসেক পানি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে ভারত থেকে অগণিত পানির পাম্প দিয়ে অধিক পরিমাণে পানি ভারতে নেওয়া হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের ফেনী নদী পরিবেশগত ব্যাপক সংকটের মুখে আছে এবং ক্রমাগত অস্তিত্বের হুমকিতে রয়েছে।’
‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের সংবিধান লঙ্ঘন করে আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্র ছাড়াই এবং কোনো রূপ বিনিময় ছাড়াই বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পানি সরবরাহের অনুমতি দিয়েছে। এছাড়া ভারত সরকারকে তাদের পানির পাম্প দিয়ে বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা হয়েছে।’
তাই এই আইনি নোটিশ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছাড়া বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পানি সরবরাহ বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে এবং ফেনী নদীর ওপর থেকে ভারতের সব পানির পাম্প অপসারণের দাবি জানানো হয়েছে। অন্যথায়, এ বিষয়ে ব্যাবস্থা নিতে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করা হবে বলেও নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।এদিকে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙার ভগবানটিলায় জন্ম নেয়া ফেনী নদী তীরবর্তী মানুষের কাছে ‘ভগবানের’ মতোই। এই নদীর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। এই নদীর পানি দিয়েই ফলান ফসল। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করেন এই নদী হয়েই। ফলে শুধু খাগড়াছড়ি নয়- চট্টগ্রাম ও ফেনীর মানুষের কাছেও ফেনী নদী ভরসার অপর নাম; বিপদের সময়ের পরম এক বন্ধু।
তবে এসবই এখন সোনালী অতীত! ভারতের ইচ্ছেমতো পানি তোলা, বন-জঙ্গল কেটে উজাড় করায় পাহাড়-টিলা ধসে তলদেশ ভরাট, ময়লা-আর্বজনা ফেলায় ফেনী নদীর অস্তিত্ব বিপন্নের পথে। নাব্য হারানোর কারণে নদী সংলগ্ন সেচ প্রকল্পগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তলদেশ ভরাট হয়ে গভীরতা কমে যাওয়ায় বর্ষায় নদী প্লাবিত হয়ে নিম্ন-এলাকায় বন্যা দেখা দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপন্ন অবস্থা থেকে ফেনী নদীকে পুনরুদ্ধারের উপায় খুঁজতে দ্রুতই সমীক্ষা শুরু করা প্রয়োজন। এর ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা দরকার।পাহাড় কেটে জমির শ্রেণি পরিবর্তন: শুধু নদী দখল নয়, অবাধে পাহাড় কাটাও চলছে খাগড়াছড়ির নয় উপজেলায়। দিনদুপুরে প্রকাশ্যে বা রাতের আঁধারে পাহাড় কেটে অন্য জায়গায় মাটি বিক্রি করছেন পাহাড়খেকোরা। পাহাড় কাটার পাশাপাশি নদী-খাল, ছড়া-ঝিরি অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়ে হারাচ্ছে নিজস্ব গতিপথ। জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালালেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।
খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হাসান মারুফ জানান, পাহাড় কাটার ব্যাপারে আমরা শক্ত অবস্থানে রয়েছি। খবর পেলেই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জেল-জরিমানা করছি। অন্যদিকে, খাগড়াছড়ি পৌরসভার প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম জানান, ছড়া ও খাল যাদের অবৈধ দখলে রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দীঘিনালায় উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল: খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় নানা কারণে উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল। এ কারণে উপজেলার পাহাড়গুলো পরিণত হচ্ছে বৃক্ষহীন এক বিরানভ‚মিতে। সবুজে ঘেরা পাহাড়গুলো ক্রমান্বয়ে হয়ে পড়ছে বৃক্ষহীন। সনাতন পদ্ধতির জুমচাষ, ইটভাটা ও তামাকচুল্লিতে লাকড়ি হিসেবে কাঠের ব্যবহার, কাঠের চাহিদা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
বেড়েছে অবৈধ বালি উত্তোলন: হালদা নদীর উজান খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে অবাধে চলছে বিষাক্ত তামাকচাষ এবং অবৈধ বালি উত্তোলনের মহোৎসব। যোগ্যাছোলা, গোদাতলী, গোরখানা, ছদুরখীল, বড়বিল, তিনঘরিয়া পাড়া, ডাইনছড়ি ও বাটনাতলী এলাকায় হালদা খাল ও আশপাশের কৃষিজমি, খাল ও ডোবা থেকে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে উত্তোলন করা হচ্ছে শত শত ট্রাক সাদা ও লাল বালি। ফলে হালদা নদীর যোগ্যাছোলা থেকে বাটনাতলী অংশের অধিকাংশ পাড়ই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে আছে।
হুমকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য: হালদার বুক ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা আফরোজ ভুঁইয়া বলেন, গোপনে যেসব স্থানে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করা হয়, সেখানে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
ময়লা-দুর্গন্ধে মলিন পানছড়ি: ভারত সীমান্তঘেঁষা পানছড়ি ছিল সবুজ বনায়নে ঘেরা এক উপজেলা। যতদূর চোখ যেতো ততদূর সারি সারি গাছ ছিল। তবে সেই সোনালী সময় এখন আর নেই। সবখানে ময়লা আর দুর্গন্ধ। বড় বড় গর্ত আর ধূলাবালিতে ভরা পানছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কও এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। পানছড়ি উপজেলা রেঞ্জ অফিস সূত্রে জানা যায়, সরকারিভাবে সামাজিক বনায়নের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
টিলা গিলে খাচ্ছে আফ্রিকান কাসাভা: পার্বত্য চট্টগ্রামে দিন দিন বাড়ছে আফ্রিকার কৃষিজ ফসল কাসাভা চাষ। তবে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করায় উর্বরতা হারাচ্ছে শত শত পাহাড়ি টিলা। বন উজাড় করে কাসাভা চাষের কারণে জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়েছে। জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ ব্যতীত পাহাড়ে কাসাভা চাষ বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে খাগড়াছড়ি বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এবং জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটির সদস্য সচিব মো. ফরিদ মিয়া বলেন, খাগড়াছড়িতে সরকারের বন্দোবস্তি দেওয়া পাহাড়ি টিলাগুলোতেই কাসাভা চাষ হচ্ছে। ফলে এখানে বনবিভাগের কিছু করার এখতিয়ার নেই।