পুলিশে কাটছে না অস্থিরতা

সাত মাসেও পুলিশ বাহিনীর ভেতরের অস্থিরতা পুরোপুরি কাটেনি। দূর হয়নি সংকটও। কিছুটা গতিশীল হলেও পদায়ন-বদলি, পদোন্নতি বা চাকরিচ্যুতি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিভক্তিসহ নানা ধরনের জটিলতা এখনো রয়েছে রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা পুলিশ বিভাগে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ও পুলিশ সদর দফতরের মধ্যে বড় ধরনের দুরত্ব ওপেন সিক্রেট। ফলে অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিআইজির অর্ধশত পদ কয়েক মাস ধরে খালি থাকার পরেও পদোন্নতি বা পদায়ন করা হচ্ছে না। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের মধ্যে রশি টানাটানি চলছে। এতে করে সারা দেশে আইন-শৃংখলা উন্নয়ন, নাগরিকসেবা, সামাজিক শৃঙ্খলা ও আইনি সুরক্ষার কাজটিও যথাযথভাবে হচ্ছে না। বরং কোথাও কোথাও পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকারকে সম্পূর্ণভাবে গতিশীল করতে হলে রাষ্ট্রের এই প্রতিষ্ঠান পুলিশ বাহিনীকে দ্রুত সক্রিয় করতে হবে। পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন), সেটিও খালি রয়েছে দীর্ঘদিন। যোগ্য ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে দ্রুত পদায়ন করা খুবই জরুরী। এমনকি ১৭ ফের্রুয়ারী যশোর, নোয়াখালী, কক্সবাজার ও সুনামগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হলেও গত ১৬ দিনেও চার জেলায় কাউকে এসপি হিসেবে পদায়ন করা হয়নি। যা পুলিশ বাহিনীতে নজিরবিহীন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতন হলেও হত্যায় অভিযুক্ত ও ইন্ধদাতা পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে এখনও অনেক কর্মকর্তাই বহাল রয়েছেন। যারা জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি চালানো এবং হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত। একই সাথে একাধিক হত্যা মামলার আসামি হয়েও অনেক কর্মকর্তাই পুলিশ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের নানা পদে রয়েছেন। এসব কর্মকর্তারা একদিকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার করছেন পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা এবং পতিত আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের কাছে, অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে থাকলেও দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা উন্নয়নে তেমন কোন ভূমিকা রাখছেন না। ফলে দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি উন্নতির ক্ষেত্রে ধীরগতিতে কাজ করতে হচ্ছে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, এখন একটি কঠিন সময় যাচ্ছে। এ ধরনের বিপ্লবের পর সব দেশেই অসুবিধা হয়। এগুলো কাটিয়ে উঠার চেষ্টা চলছে। পুলিশ বাহিনীতে পদ শূণ্য থাকলে তা দ্রুত পূরণ করা উচিত। বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী দক্ষ ও পেশাদার। আমার বিশ্বাস তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা উন্নয়ণে ভুমিকা রাখবেন।
আইজিপি বাহারুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, পদোন্নতি ও শূণ্য পদে পদায়নের জন্য পুলিশ সদর দফতর কাজ করছে। একই সাথে দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, পুলিশ সদর দফতরসহ অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার ১৯টি ও ডিআইজি ৩৫টি পদ শূণ্য রয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারনে যোগ্য কর্মকর্তা থাকার পরেও সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে গঠিত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) বৈঠক দীর্ঘদিন ধরে না হবার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অনেকটাই নিস্ক্রিয়। ফলে পুলিশ পুন:গঠন ও সারাদেশের পুলিশ ইউনিটগুলোকে সক্রিয় করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। শহীদদের রক্তের বিনিময়ে দেশে নতুন সরকার গঠন হলেও খুনের সাথে জড়িত শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়েই বৈঠক করছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ সদর দফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা। আ’লীগের ক্যাডারদের রেখে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার করা সম্ভব নয়। অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিআইজিদের পদোন্নতি দেয়া হলে দ্রুত অতিরিক্ত ডিআইজি, এসপি ও অতিরিক্ত এসপি পদে পদোন্নতি পাবেন যোগ্য-বঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তারা। সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ প্রশাসনের বাইরে অন্যান্য ক্যাডারে এ ধরনের শূণ্য পদ থাকার নজির নেই। দেশের আইন-শৃংখলা যেন উন্নয়ন না হয় এবং পুলিশ বাহিনীর মধ্যে চেনই-অব কমান্ড যেন ফিরে না আসে সে জন্যই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পদোন্নতি ও পদ খালি রেখে চলছে পুলিশ বাহিনী। এমন মন্তব্য করেন এ সব কর্মকর্তা ।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতন হলেও হত্যায় অভিযুক্ত ও ইন্ধনদাতা পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা সদর দফতরের বিশেষ মনিটরিং সেল থেকে সারাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ও নিপীড়নের আদেশ সমন্বয়ের কাজ করেছেন ফ্যাসিবাদের সেসব দোসররা পদায়ন পেয়ে এখনো বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপার, এসবি, সিআইডি, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত রয়েছেন। ফলে আওয়ামী লীগের আমলে বৈষম্যের শিকার পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো বঞ্চিত হচ্ছেন। এর ফলে পেশাদার, সৎ ও বঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে পুলিশে নিয়োগ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। এই সময়ে বরাদ্দ বেড়েছে ৪৩৩ শতাংশ। কিন্তু পুলিশকে পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার কার্যকর কোনো উদ্যোগ ছিল না; বরং পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের অতিরিক্ত পুলিশ নির্ভরতায় বাহিনীটির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সাত মাসেও পুলিশ কার্যকর ভূমিকায় যেতে পারছে না।
পুলিশের বর্তমান ও সাবেক সদস্য ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশকে সেবামুখী করতে এবং মামলা ও এর তদন্ত, গ্রেপ্তার এবং অভিযানসহ সব ক্ষেত্রে জবাবদিহির আওতায় আনতে শক্ত কাঠামো তৈরি করতে হবে। এ জন্য পুলিশ-সংক্রান্ত কিছু আইন ও বিধান যুগোপযোগী করতে হবে। পরপর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে পুলিশ বাহিনীর বড় অংশ দলীয় কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এদের মধ্যে যে সব পুলিশ কর্মকর্তারা অতিউৎসাহী ও অপেশাদার কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করা জরুরী।