Status

পুকুরের নগরী রাজশাহী এখন পুকুরশূন্য

রেজাউল করিম রাজু : পুকুরটিতে এখনো পানিতে ভরা। মানুষ গোসল করছে, কাপড় ধুচ্ছে। দামাল ছেলেরা সাঁতার কাটছে। অথচ ভূমি অফিসের কাগজপত্রে আবাসিক ভিটা হয়ে গেছে। বর্তমান মালিক খাজনা দিচ্ছেন। আর অপেক্ষায় রয়েছেন ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রির জন্য। এমন একটি বর্তমান পুকুর হলো নগরীর ২৩/২৪ নম্বর ওয়ার্ড সংলগ্ন মেহেরের পুকুর বলে পরিচিত। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে জ্যান্ত পুকুরকে হত্যা করে আবাসিক ভিটা বানানো হয়েছে। নিউ ডিগ্রী কলেজ এর পাশের পুকুর শুকান দিঘী ভরাট হয়ে গেছে। ঐতিহাসিক সোনাদিঘী এখন সোনা ডোবায় পরিনত।

শুধু আলোচ্য মেহেরের পুকুর নয় গত দশ বছরে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে হাজারো পুকুর ভরাট হয়েছে। যা এখনো চলছে। হাইকোর্টের রায় আছে নগরীর পুকুর ভরাট বন্ধ। যেগুলো ভরাট হয়েছে সেগুলো পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। নগরীর পুকুর ভরাট নিয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী মনজিল মোরশেদ হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ এর পক্ষে ২০১৪ সালে রিট করেন। এর পরিপেক্ষিতে নগরীর পুকুর গণনা করে বোয়ালিয়া ভূমি কার্যালয় এসময় ৯৫২টি পুকুরের তালিকা পাওয়া যায়। ২০২২ সালের ৮ আগস্ট হাইকোর্টে দ্বৈত বেঞ্চ নগরীতে পুকুর ভরাট বন্ধসহ বিদ্যমান ৯৫২টি পুকুর সংরক্ষনসহ কয়েকটি নির্দেশনা দেন। নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে রাজশাহী শহরে আর যেন কোনও পুকুর ভরাট বা দখল না হয় তা নিশ্চিত করতে বলেছে। ভরাট হওয়া পুকুরগুলো পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। বিবাদী সিটি মেয়র পরিবেশ অধিদফতর রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন, পুলিশ কমিশনার, র‌্যাবকে। অথচ একের পর এক পুকুর ভরাট হয়ে যাচ্ছে তারা নির্বিকার। পুকুরের শ্রেণী পরিবর্তন করে ভিটা করার বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানে জানা যায় ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের মেহেরের পুকুরটি নিয়ে খোদ ভূমি অফিস জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের যোগ সাজসে শ্রেণী পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এজন্য চুক্তি মোতাবেক কাঠা প্রতি স্থান ভেদে দুলাখ থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত গুণতে হচ্ছে। আহম্মদপুর স্কুলের সামনে আরাজি শিরইল মৌজার পুকুরটির খতিয়ান নম্বর ৪৪, জেএল ১১ শ্রেণী পুকুর। যা বহুকাল ধরে মেহেরের পুকুর নামে পরিচিত। বোয়ালিয়া ভূমি অফিস তা ভিটা করে দিয়েছেন। এই পুকুরটি ভরাট বন্ধের জন্য এলাকাবাসী মানববন্ধন করেছিলেন জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদফতর, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন নিবেদন করেছেন কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিভাগীয় কমিশনার ও সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক পুকুরটি সংরক্ষন ও ভরাটকৃত অংশ পরিস্কারের জন্য প্রধান প্রকৌশলীকে নির্দেশ দিলেও তা মানা হয়নি। মেহেরের পুকুরসহ পোস্টাল একাডেমীর পাশের পুকরের শ্রেণী পরিবর্তনের ক্ষতিয়ানে স্বাক্ষর করেছেন বোয়ালিয়ার তৎকালীন এসিল্যান্ড শাহীন মিয়া। প্রায় আঠারোটি খতিয়ানে অনুমোদন দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন এটা অসাবধানতা বশত: করনিক ভুল। এমন ভুল হয়েছে শত শত। এমন জালিয়াতি বছরের পর বছর ধরেই হয়ে আসছে। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে খারিজের বিষয়টি প্রমানিত হলেও কারো বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি নদী বাঁচাও ও জলাশয় বিষয়ক গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, রাজশাহী নগরীতে ষাটের দশকে চার হাজারের বেশী পুকুর দিঘী ও অন্যান্য জলাশয় ছিল। ১৯৮১ সালে তা নেমে আসে দুই হাজারের ঘরে। ২০০৯ সালে এক হাজারের কম। তিনি পুকুর ভরাট ঠেকাতে ২০১০ সালে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। আদালত ২০১০ সালে রাজশাহী নগরীর সব ধরনের জলাশয় ভরাটে নিষেধাজ্ঞা জারী করেন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জবাব দিতে বলেন। ২০১২ সালে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নিবে বলে লিখিত দিয়েছিল উচ্চ আদালতকে। কিন্তু তারপর পুকুর ভরাট থামেনি। বরং তারা এসব ভরাট হওয়া পুকুরের উপর ভবন নির্মানের প্ল্যান দিয়েছেন। মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, বর্তমানে ‘শ’খানেক পুকুর রয়েছে। সেগুলো ময়লা ফেলে নষ্ট করে ভরাট করার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে যাদের এসব দেখভাল করার কথা তারা পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।

রাজশাহীর পুকুর জলাশয় ভরাট নিয়ে পত্র পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হলে প্রখ্যাত আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ২০১৪ সালে একটি রিট করেন। ২০২২ সালে ৮ আগস্ট সালেও নগরীর ৯৫২টি পুকুর সংরক্ষন ও ভরাটকৃত পুকুর পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চার দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন। আদালতের নির্দেশনাকে পাত্তা না দিয়ে পুকুর ভরাট অব্যাহত রয়েছে। নগরবাসীর চোখের সামনে একের পর এক দিঘী পুকুর ভরাট হলেও তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানববন্ধন, সংশ্লিষ্ট দফতর সমূহে আবেদন নিবেদন করলেও তখন বলা হতো খোদ মেয়র ক্ষমতাবলে রাজনৈতিক দলের বড় বড় নেতার নাম। আর স্থানীয় কাউন্সিলররা মিলেমিশে সব করেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে এসব হয়েছে। আর ফায়দা লুটেছে দেখভালকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের ক্ষমতা নেই।

জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদফতর, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেও এখন কেন তারা নিশ্চুপ তার কোন উত্তর নেই। নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডবাসী বলছেন তারা চার বছর ধরে মেহেরের পুকুরটি ভরাট বন্ধের ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা নেবার জন্য আবারো আবেদন নিবেদন করছেন। কিন্তু এরা কেউ পাত্তা দিচ্ছেনা। কেননা পদ্মা নদীর ক্ষীন ধারা অনেক দূরে সরে গেছে। নদী তীরবর্তী এই পুকুরটি মানুষের ভরসা। তাছাড়া পাশ্ববর্তী বস্তীতে আগুন লাগলে তা নেভানোর কোন উপায় নেই।

সচেতন নাগরিক কমিটির রাজশাহী জেলা সভাপতি (সনাক) আহমেদ শফিউদ্দিন বলেন, পুকুর ভরাটের কারণে রাজশাহীর পরিবেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আবহাওয়া বিরুপ আচরণ করছে। তীব্র গরম পড়ছে। এক সময় নগরীর হাজার হাজার পুকুর পরিবেশের উপর বিরাট ভূমিকা রাখতো। মানুষ পুকুরে গোসল কাপড় ধোয়া, মাছ ধরা সবকিছু করতো। এমনকি বৃষ্টি পানি সংরক্ষনের আধার হিসাবে কাজ করতো। নিচের পানি পুনঃভরণ হতো। হাত টিউবওয়েলে এমনিতে পানি পাওয়া যেত। এখন সেমী ডিপ টিউবওয়েলেও পানি পাওয়া যায়না। পানির স্তর নেমে গেছে শত ফুটের নীচে। ফলে এখন আর মহল্লায় মহল্লায় বাড়িতে বাড়িতে টিউবওয়েল দেখা যায়না। অথচ এগুলো পানের জন্য বিশুদ্ধ পানির আধার।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রাজশাহী বিভাগীয় আহবায়ক তন্ময় কুমার স্যানাল বলেন, নগরীর সব জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ার জন্য মূলত দায়ী জেলা প্রশাসন, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আর পরিবেশ অধিদফতর। তাদের গাফলতির কারণে সব পুকুর ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে রাজশাহীর আবহাওয়া চরম ভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। গ্রীস্মে অতিরিক্ত গরম আর শীতে বেশি শীত অনুভূত হচ্ছে। সেজন্য জলাশয় দরকার। এখনি ব্যাবস্থা না নিলে পরিবেশ আরো খারাপ হয়ে উঠবে। তখন আর করার কিছুই থাকবেনা।

রাজশাহী ফায়ার ব্রিগেডের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেন, নগরীতে জলাশয় না থাকায় তারা পানির সঙ্কটে ভুগছে। এই প্রতিবেদক নগরীর পুকুর ভরাট নিয়ে হাইকোটের নির্দেশনার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীলদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও ভরাট হওয়া পুকুরগুলোর ব্যাপারে তারা কি ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং এমন কোনো উদাহরণ আছে কিনা তার সদউত্তর মিলেনি। সচেতন মানুষ বলছেন রক্ষকরাই যদি ভক্ষক হয় তাহলে কি হবে।

Source link

Back to top button