পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে নতুন দল এনসিপি’র আত্মপ্রকাশ কেমন হলো?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা হলো সম্প্রতি, ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সমর্থনে একটি নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করল। দলটির নাম হল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ বা এনসিপি। দীর্ঘ সময় ধরে চলা জল্পনা-কল্পনা শেষে অবশেষে দলটি এর প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছে। একদিকে যখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল, তখন এ নতুন দলের অভ্যুদয় নতুন আশার বার্তা নিয়ে এসেছে।
নতুন দল এনসিপি এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে আত্মপ্রকাশ করে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়, গতকাল শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) মানিক মিয়া এভিনিউতে দলটির প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। অনুষ্ঠানটি শুরু হওয়ার কথা ছিল বিকেল ৩টায়, তবে কিছুটা দেরিতে, অর্থাৎ সাড়ে ৪টায় অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানটি শুরু হয় চার ধর্মের ধর্মগ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে, যা দলের বৈচিত্র্য এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক হিসেবে ধরা হচ্ছে।
এই দলের যাত্রা শুরু করার জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এবং জামায়াতে ইসলামী সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার দলের নতুন যাত্রাকে স্বাগত জানান। তাঁদের বক্তব্যে দলটির ভবিষ্যৎ সাফল্য এবং লক্ষ্যকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয়।
নতুন দল এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্বও ঘোষণা করা হয়। দলের আহ্বায়ক হিসেবে নাহিদ ইসলাম এবং সদস্য সচিব হিসেবে আখতার হোসেনের নাম ঘোষণা করা হয়। এই পদক্ষেপটি দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই নেতৃত্ব নতুন রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে নির্দেশিত করে। দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়কের দুটি পদে সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদীব দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব হিসেবে তাসনিম জারা ও নাহিদা সারওয়ার নিবা দায়িত্ব পালন করবেন। দলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বিভিন্ন নেতাদের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে, যারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।
দলটি দাবি করছে, তারা দেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে প্রস্তুত। এনসিপির নেতৃবৃন্দ একযোগে একটি নতুন রাজনৈতিক দর্শন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করছেন। এই দলের লক্ষ্য শুধুমাত্র বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়, বরং একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আত্মপ্রকাশের দিন ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত ছিলেন, যদিও অনুষ্ঠানে জনসমাগম প্রত্যাশিত পরিমাণে ছিল না। তথাপি, অনুষ্ঠানে ঢাকার বাইরের বেশ কয়েকটি জেলা থেকেও কর্মীরা যোগ দিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৫০টি বাস নিয়ে কর্মীরা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন আন্দোলনে নিহতদের পরিবার এবং আহতরা। এটি দলের প্রতি মানুষের আস্থার প্রকাশ এবং তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে এগিয়ে চলার দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক।
অনুষ্ঠানে নেতৃবৃন্দ মঞ্চে বসে তাদের বক্তব্য রাখেন, যেখানে চেয়ার এবং টেবিলের কোনও ব্যবস্থা ছিল না, যা দলের নতুনত্ব এবং একতাবদ্ধতার প্রতীক হিসেবে দেখা যায়। একদল তরুণ ও যুবক সমর্থকরা বলেন, পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা দেখে তারা ক্লান্ত, এবং নতুন দলটি একটি নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসবে, এ বিষয়ে তারা আশাবাদী। এই ধরনের বক্তব্য দলটির আদর্শ এবং পরিবর্তন আনার উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করে।
এনসিপি’র আত্মপ্রকাশের পর বিএনপি এবং জামায়াত নেতাদের প্রতিক্রিয়া ছিল ইতিবাচক। বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দলের প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন জানান এবং বলেন, “একজন সাবেক ছাত্রনেতা হিসেবে আমি গর্বিত যে ছাত্ররা একটি জাতীয় পর্যায়ের সংগঠন করছে।” তিনি ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক ভাষা ও ধারার প্রশংসা করেন এবং একে দেশের রাজনীতির জন্য একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত হিসেবে দেখেন।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “আমরা নতুন দল এনসিপিকে স্বাগত জানাচ্ছি এবং তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পথে থাকবো।” জামায়াতের নেতারা এটি স্পষ্ট করেন যে তারা নতুন দলের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত এবং তাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে।
নতুন দল এনসিপি প্রতিষ্ঠার সময় স্লোগানগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” এবং “ক্ষমতা না জনতা, জনতা জনতা” স্লোগানগুলি দলের সাধারণ মানুষের প্রতি অভ্যুত্থান এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতি একাগ্রতার প্রতীক ছিল। নেতারা এটি ঘোষণা করেছেন যে তারা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবেন। তাদের মূল লক্ষ্য হল একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা, যা গণতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশ পরিচালিত হবে এবং সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।
নাহিদ ইসলাম, দলের আহ্বায়ক, তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বা ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তারা সংগ্রাম করবেন। তিনি বলেন, “২০২৪ সালের অভ্যুত্থান সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াই সূচনা করেছে।” নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং জনগণের অধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে দলের কার্যক্রম শুরু হবে। তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশে ভারতপন্থি বা পাকিস্তানপন্থি রাজনীতির কোনো ঠাঁই হবে না,” যা দলের জাতীয়তাবাদী দর্শনকে তুলে ধরে।
এনসিপি’র নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন যে তারা সরকার পতনের পরিবর্তে একটি নতুন রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে চান, যেখানে জনগণের অধিকার প্রাধান্য পাবে। এটি তাদের রাজনৈতিক দর্শনের মূল বিষয়, যা আগামী দিনগুলিতে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্য তারা নির্ধারণ করেছেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দেশবাসীর কাছে তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্য তুলে ধরেছে। তারা পরিবর্তনের আশা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছে। বিএনপি, জামায়াত, এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সমর্থন এবং উপস্থিতি তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে। যদিও দলের ক্ষমতায় আসা এখনই স্পষ্ট নয়, তবে সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে তারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবে, এবং ভবিষ্যতে আরও ব্যাপক সমর্থন অর্জন করবে বলে তারা আশা করছেন।
এনসিপি’র আত্মপ্রকাশ বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে। এটি একটি দলের বাইরেও বৃহত্তর আন্দোলনের আকার ধারণ করতে পারে, যা দেশের গণতন্ত্র এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। এখন দেখতে হবে, দলটি কীভাবে নিজেদের লক্ষ্য অর্জন করে এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা