Facebook Bio Status

নেই সেই দস্যুতা, তবুও কাটে না দুর্দশা


ইলিশের জন্য বিখ্যাত বরগুনার পাথরঘাটা জনপদ। উপকূলীয় এই জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা চলে ইলিশকেন্দ্রিক। এই ইলিশ জেলেদের টার্গেট করেই এখানে ছিল সুন্দরবনের জলদস্যুদের বিশাল নেটওয়ার্ক। জলে কিংবা বনে, জলদস্যুদের আনাগোনা ছিল পাথরঘাটার সর্বত্র। সেই দস্যিপনার অনেকটাই ইতি ঘটেছে। তবুও উন্নতি হয়নি স্থানীয় জেলেদের জীবনমান। অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। ঋণের বোঝা, এনজিওর টাকা, দাদনসহ নানা অসুবিধায় জড়িয়ে আছে জেলেরা। শ্রমে-ঘামে প্রতিদিন তাদের শরীর ভেজে ঠিকই, তবে পাল্টায় না জীবনের গল্পটা।

সরেজমিন জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত এক দশক আগেও সাগরে রাজু, গামা, নাসির, নূর হাবিব, শহিদ, সোবাহান, নানা, মহুবর, বড় ভাই, মাইজ্যা ভাই, কবির, বাদল, মুকুল, সাকাত, আনোয়ার, বেলাল, সজল, জালাল, মাহাতাব, সিদ্দিক, জিহাদ, শিষ্য ও বাদলবাহিনী নামে বেশকিছু সক্রিয় বাহিনী ছিল। বিভিন্ন সময় র্যাবের হাতে দস্যু বাহিনীর প্রধানসহ অনেকেই মারা গেছেন। প্রশাসনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলে কাজ করে জলদস্যু নির্মূল করেছে বিভিন্ন বাহিনীও। অনেককে গ্রেফতার হয়েছে কোস্টগার্ড, পুলিশের হাতে। বাকিদের অধিকাংশই আত্মসমর্পণ বা অস্ত্র জমা দিয়েছে সরকারের কাছে। এতে অনেকটাই শান্তি ফিরেছে জেলেদের জনপদে। দস্যিপনা থেকে মোটামুটি মুক্তি মিলেছে জেলেরা। তবে বিদায় নেয়নি জেলেদের দুর্দিন। জলদস্যুদের টাকা দিয়ে ফিরে আসা অনেকেই আজও সচ্ছল হতে পারেননি।

কথায় বলে, অভাগা যেদিকে তাকায়, সাগর শুকিয়ে যায়। তেমনি এক বাস্তবতার সম্মুখীন পাথরঘাটার ইলিশ জেলেরা। এক বিপদ কাটে তো অন্য বিপদ হাজির হয়। একটু স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন, টিন-কাঠের সুন্দর ঘর তোলার স্বপ্ন, ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর স্বপ্ন, নতুন জামা-শাড়ি কেনার স্বপ্ন, শীতার্ত রাতে কাঁথার সঙ্গে লেপ বা কম্বল জড়ানোর স্বপ্ন তাদের। সেই স্বপ্ন যেন স্বপ্নই রয়ে যায় জেলে জীবনে।

জীবনমান ও সার্বিক অবস্থা নিয়ে কথা হয় অঞ্চলটির স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে। জানা যায়, জেলেদের শোচনীয় আর্থিক অবস্থার নানা কারণ। জেলে ফারুক আহম্মেদ বলেন, বছরান্তে আম্ফান, আইলা, সিডর, ফনির মতো নানা দুর্যোগ উপকূলে ছোবল মারে। অবস্থানগত কারণেই সমুদ্রকূলের এই জনপদটি ঝড়-বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঝড় এসেই গোছালো ঘর-গৃহস্থালি লণ্ডভণ্ড করে দেয়। সেই ক্ষতি পুষিয়ে আবার নতুন করে ঘর গোছাতে বেশ সময় লাগে। হাতে জমানো টাকা-পয়সা থাকলেও তা শেষ হয় ঘর মেরামতে। এমন বিরূপ আবহাওয়া জেলে পরিবারগুলোকে আর্থিক সচ্ছলতায় ফিরতে দেয় না।

জেলে হাবিব হাওলাদারের বক্তব্যের সারমর্ম ছিল এমন-জেলেদের আর্থিক অবস্থা অবনতির আরেকটি কারণ মাছ বিক্রির প্রথা। আধুনিক ব্যবসায় যাকে ‘অগ্রিম’ বলা হয়, ইলিশ জেলেদের কাছে সেই শব্দটি পরিচিত ‘দাদন’ নামে। এই দাদন চক্রেই বাধা পড়ে জেলেদের জীবন। এ প্রথায় একজন জেলে শ্রমিক জিম্মি থাকে ট্রলার মালিকের কাছে। ট্রলার মালিক বাধা থাকে স্থানীয় আড়তদারদের কাছে। আবার মফস্বল অঞ্চলের আড়তদার বাধা থাকে রাজধানীসহ বড়সব পাইকারদের হাতে। মাঝখানে থাকে কিছু মধ্যসত্তভোগিও। ফলে মাছের দাম নির্ধারণ ও বাজার নিয়ন্ত্রিত হয় মহাজনদের নির্দেশনায়। মোটের ওপর ঠকে যায় জেলেরা। নিজেদের ধরে আনা মাছের দাম নির্ধারণ করতে পারে না তারা।

স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলতেই জেলে অসংগতির নানা বিষয় উঠে আসে। তেমনই পাথরঘাটা অঞ্চলের একজন উচ্চশিক্ষিত তরুণ সাখাওয়াত হোসেন সৌখিন। তিনি বলেন, ‘নানা প্রতিকূলতা সামাল দিতে হয় জেলেদের। দেশে প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন হলেও বাদ পড়েছে এই ক্ষেত্রটি। সমুদ্রে যাওয়া মানেই যেন, নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাওয়া। ঝড়ের কবলে পড়লে, নিয়তিই যেন জেলেদের একমাত্র ভরসা। ঝড়ে পাল্টে যায় গতিপথ ও কূলের নির্দেশনা। ফলে হারিয়ে যায় ট্রলারটি, নিখোঁজ হয় ওই ট্রলারের জেলেরাও। কোনো আধুনিক ডিভাইস বা ইনডিকেটর থাকে না জেলে বহরে, যার মাধ্যমে খোঁজ মিলতে পারতো জেলেসমেদ হারিয়ে যাওয়া ট্রলারটির।’

নেই সেই দস্যুতা, তবুও কাটে না দুর্দশা

পাথরঘাটা স্থানীয় সাংবাদিক সফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘জেলেদের ট্রলারের বীমা করা যায় না। আর বীমা না থাকায় পায় না কোনো ক্ষতিপূরণ। এর অন্যতম কারণ এসব ট্রলারের ফিটনেস নেই। এসব জটিলতার কারণে, কোনো জেলে তাদের ট্রলারটিকে প্রোপার্টি (মরগেজ) দেখিয়ে ব্যাংক ঋণ পায় না। আবার মাছ ধরার মতো একটি পেশার অনুকূলে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থাও চালু নেই ব্যাংকে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ মরগেজ না দিতে পারায় জেলেরা ব্যক্তিগত ঋণও পায় না। জেলেদের অভিযোগ, দেশে আনসার বিডিপি, প্রবাসী, বিজিবিদের জন্য আলাদা ব্যাংক থাকলেও জেলেদের জন্য নেই ঋণ ব্যবস্থাও। আর এসব কারণে অর্থকষ্টে থাকা নিরুপায় জেলেরা ধন্না ধরে এনজিও কাছে। চড়া সুদের ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ে তারা। পাশাপাশি ভারি হতে থাকে ব্যক্তিগত ঋণের বোঝা আর স্থানীয় দোকানের বাকির খাতা।’

তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার অভাব, আর জন্মনিয়ন্ত্রণে সঠিক জ্ঞান না থাকায় বেড়েই চলে পরিবারের আকার। একেক জেলের ঘরে চার থেকে পাঁচজন সন্তানও দেখা যায় হরহামেশাই। দুবেলা দু-মুঠো খেয়ে পরে বাঁচার জন্য জেলে পরিবারের সবাই কাজ করে। ঘরের কর্তার পাশাপাশি নারীরাও করে নানা কাজ। শিশুরাও নামে কষ্টসাধ্য কাজে। কাজের কারণে চিরতরে তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায় স্কুল-পড়ালেখা।’

স্থানীয় সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য না থাকায় অভাব পিছু ছাড়ে না তাদের। জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে কোনো সেমিনার-সিমপোজিয়াম চোখে পড়ে না। জেলেরা জানেই না দেশের মৎস্য অর্থনীতিতে তাদের অবদান কতটা। দেশের জিডিপিতে তাদের কেমন অবদান তা সম্পর্কেও ধারণা নেই তাদের। ইলিশের জিআই ঘিরে প্রশংসিত হয় দেশ, তবে সেই আনন্দের লেশ মাত্রও পৌঁছায় না জেলেদের হৃদয়ে। ফলে মানসিকভাবেও জেলেরা উন্নত হতে পারে না।’

প্রতিবছর মৌসুম শুরুতে জেলেরা ইলিশ শিকারে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে কয়েক গুণ। সাগরে মাছ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায় আশা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানা ভয়কে উপেক্ষা করে সাগরে যায় জেলেরা। তবে ইদানীং বদলে যাচ্ছে সমুদ্রের আচরণ। এতে বিপাকে পরে জেলেরাই। জলবায়ুর প্রভাবে মাছের মৌসুমে খরা, আর খরার সময়ে জাল ভরা মাছ উঠছে। এতে অনেক সময় পণ্ডশ্রম দিয়ে ফিরতে হয় সমুদ্র থেকে। আবার হঠাৎ মাছ পেলেও সঠিক দাম পায় না তারা। বিরূপ আবহাওয়ার এ তালবাহানা জেলে জীবনের ছন্দপতন ঘটায়।

বছরের পর বছর কষ্টে জীবন কাটে জেলে জনপদে। যেন দারিদ্রতাই তাদের সঙ্গী। সরকারি সহায়তা যতটুকু আসে, তাতেও আবার ভাগ বসায় শত শত ভুয়া জেলেরা। অবশেষে নিয়তিকেই দোষারোপ করেন তারা। তারা ভেবে নেন, ‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লিতে’।

কেএসকে/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।



Source link

Leave a Reply

Back to top button