
বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের জন্য পাড়ি জমানো নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত নারীদের অনেকেই নিপীড়ন, প্রতারণা ও শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ফলে তারা বাধ্য হয়ে দেশে ফিরছেন দুঃসহ অভিজ্ঞতা নিয়ে। এছাড়া বিদেশে কাজ করতে আগ্রহী নারীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে দক্ষতার অভাব। ফলে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে।
২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাওয়া নারী কর্মীর সংখ্যা ৮ লাখ ৯৫ হাজার ২১ জন।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৫-২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫ বছরের তুলনায় ২০২০-২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে নারী শ্রমিক রপ্তানির হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে এক লাখের বেশি নারী শ্রমিক বিদেশে গিয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ ১ লাখ ২১,৯২৫ জন; ২০১৮ সালে ১ লাখ ১,৬৯৫ জন নারী শ্রমিক বিদেশে যান। ২০২০ সালের পর এ সংখ্যা কমতে থাকে। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে মোট ৫,৫০,২১২ জন নারী শ্রমিক বিদেশে গেছেন। ২০২০-২০২৪ সাল পর্যন্ত সর্বশেষ ৫ বছরে এ সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩,৪৯,৮০৯ জনে।
এর মধ্যে ২০২০ সালে ২১,৯৩৪ জন নারী শ্রমিক বিদেশে যান। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে সে বছর নারী-পুরুষ উভয় শ্রমিক যাওয়ার সংখ্যা কম ছিল।
২০২১ ও ২০২২ সালে এ সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও ২০২৩ ও ২০২৪ সালে নারী শ্রমিক যাওয়া ফের কমেছে। ২০২১ সালে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ গেছেন ৮০ হাজার ১৪৩ জন, ২০২২ সালে গেছেন ১ লাখ ৫ হাজার ৪৬৬ জন। ২০২৩ সালে গেছেন ৭৬ হাজার ১০৮ জন শ্রমিক। তবে সর্বশেষ ২০২৪ সালে গেছেন মাত্র ৬১১৫৮। যা করোনাকালীন সময় বাদ দিলে গত ১০ বছরে সর্বনিম্ন।
কেন কমছে নারী শ্রমিকদের বিদেশযাত্রা?
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট, রামরু এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত নারীর অংশগ্রহণ ২২ শতাংশ কমেছে। রামরুর গবেষণা মতে, শোভন কর্মক্ষেত্রের অনিশ্চয়তার কারণে নারী কর্মীরা ক্রমেই অভিবাসনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।
এজেন্সির প্রতারণা
২০২৪ সালের জুলাই মাসে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে এসে সৌদিতে থাকা বোনের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ ও দেশে ফিরিয়ে আনার আবেদন করেন নরসিংদীর তোফাজ্জল মিয়া। তিনি বলেন, আমার বোন সুমাইয়া গৃহকর্মী হিসেবে সৌদিতে কর্মরত। কিন্ত বাসায় কাজে যোগদান করার পর থেকেই মালিক বিভিন্ন অজুহাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে থাকে। নির্যাতনের মাত্রা এতটাই ভয়ংকর যে, মাঝে মধ্যে আমার বোন অচেতন হয়ে যায়। এছাড়া আমার বোনকে ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয় না। সার্বক্ষণিক অত্যাচারের মধ্যে রাখে। কিছুদিন আগে আমার বোন গোপনে তার ওপর নির্যাতনের কিছু ছবি/ভিডিও ধারণ করতে গেলে মালিক টের পেয়ে যায় এবং আমার বোনের মোবাইলটি জব্দ করে নেয়। প্রায় মাসখানেক পর তিনি মোবাইল ফেরত দেন।
২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত নারীর অংশগ্রহণ ২২ শতাংশ কমেছে। রামরুর গবেষণা মতে, শোভন কর্মক্ষেত্রের অনিশ্চয়তার কারণে নারী কর্মীরা ক্রমেই অভিবাসনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।
তিনি বলেন, আমার বোন সোনারগাঁও ওভারসিজ নামে একটি এজেন্সির মাধ্যমে যায়। পরে আমি এজেন্সির মালিক ফখরুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কোনো সুফল পাইনি। তিনি আমাদের এ মর্মে জানান যে, আমার বোনের কাজের বিষয়ে গৃহ মালিক ও সোনারগাঁও ওভারসিজের মধ্যে ২ বছরের চুক্তি হয়েছে। এ চুক্তির মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত যদি আমার বোন মরেও যায়, তবুও তাকে দেশে ফেরত আনা তাদের পক্ষে সম্ভব না।’
আরও পড়ুন
অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, নারীদের দক্ষতা উন্নয়নের অভাব, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও যৌন হয়রানি, এজেন্সিগুলোর স্বচ্ছতার অভাব এবং নীতিগত পরিবর্তন ও দক্ষতা সংকটের কারণে নারী শ্রমিকদের বিদেশে অংশগ্রহণ কমেছে।
বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নারীরা যে টাকা খরচ করে যাচ্ছে, তারা সেখানে গিয়ে তুলনামূলক কম স্যালারি পাওয়ার অভিযোগ করছেন। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনাও অনেক রয়েছে। কিন্ত নারীরা অনেক ঝুঁকি নিয়েও যাচ্ছেন। নারী কর্মীদের ভাষ্য, তারা দেশেও অর্থনৈতিকভাবে নিরাপদ নন। সেজন্য ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছেন। নিপীড়ন-প্রতারণা কিংবা বিভিন্ন কারণে বিদেশ থেকে ফেরত আসা ২২০০০ নারী কর্মীকে আমরা সাহায্য করেছি।
সুমাইয়া ইসলাম বলেন, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য অনেক বেশি দক্ষ শ্রমিকের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে তারা সাউথ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল থেকে অনেক লোক নিয়েছে। এখানে বাংলাদেশের শ্রমিকরা কিছুটা পিছিয়েছে। সেমি স্কিলড হিসেবে কেয়ার গিভারের জন্য বাংলাদেশ থেকে তাদের চাহিদা কম।
অভিযোগের নিষ্পত্তিও কম
সর্বশেষ ২০২৪ সালে ৩৬৩ জন নারী শ্রমিকের অভিযোগ পেয়েছে বিএমইটি। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১০০ জন শ্রমিকের। বাকি ২৬৩ নারী শ্রমিকের অভিযোগ এখনো তদন্তাধীন।
ইউরোপে যাচ্ছে সামান্য
গত ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক গেছে সৌদিতে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে ১০ বছরে গেছেন ৫ লাখ ৩ হাজার ৯৩ জন। এছাড়া উল্লেখযোগ্য গন্তব্যের মধ্যে দুবাই গেছেন ৪৩ হাজার ১৩৯ জন এবং কাতারে গেছেন ৩০ হাজার ৩৮৭ জন।
তবে গত ১০ বছরে বিদেশে যাওয়া নারী কর্মীদের উল্লেখযোগ্য অংশ জর্ডানে গেছেন। পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে ১ লাখ ৩২ হাজার ৫৫ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে।
বিএমইটির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ইউরোপে যাওয়া নারী শ্রমিকের সংখ্যাও কম। গত ১০ বছরে যুক্তরাজ্যে গেছেন ৬ হাজার ৪ জন। ক্রোয়েশিয়ায় ২০ জন, ইতালিতে ২১৭ জন, রোমানিয়ায় ১৫৯ জন, মাল্টায় ২১৭ জন, সাইপ্রাসে ৩৪৬ জন, পোল্যান্ডে ৩৩ জন, চেক রিপাবলিকে ১২ জন এবং বুলগেরিয়া গেছেন ৩৫ জন।
আরও পড়ুন
অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, নারীদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এবং মধ্যস্থতাকারী দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য কমানো প্রয়োজন। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
নারীদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এবং মধ্যস্থতাকারী দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য কমানো প্রয়োজন। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
অ্যাটসেক (অ্যাকশন এগেইনেস্ট ট্র্যাফিকিং অ্যান্ড সেক্সুয়াল এক্সপ্লয়টেশন অব চিলড্রেন) দক্ষিণ এশিয়ার চেয়ারপারসন ও বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী জাগো নিউজকে বলেন, নারী শ্রম বাজারের অধিকাংশ সৌদিতে যাচ্ছে। সৌদিতে বেশি নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়। এখানে সরকারের নজরদারির অভাব আছে। ভিকটিম প্রটেকশন সার্ভিস নেই। অভিযোগের ভালো প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই।
তিনি বলেন, মেয়েরা মিনিমাম এসএসসি পাস করে যাওয়া উচিৎ। কেয়ার গিভার, গৃহকর্মীসহ সব সেক্টরে পর্যাপ্ত দক্ষতা নিয়েই যাওয়া উচিৎ। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সময় অনেক রেকোমেন্ডেশন দিচ্ছি। জানি না পরবর্তী সরকার এগুলো কতটা বাস্তবায়ন করবে।
অভিবাসী ও শরনার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির জাগো নিউজকে বলেন, নারী অভিবাসন অনেকটা অবহেলিত। নারী শ্রমিকদের জন্য ফরমাল এগ্রিমেন্ট নেই। পুরোনো চুক্তিগুলো দিয়েই চলছে। আর আমাদের নারী শ্রমিকদের সেভাবে গাইড করা হয় না। অনেকে লেখাপড়া জানে না, ভাষা জানে না। এই লিমিটেশন বেশি। যার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে তারা সহজে যেতে পারে। কিন্তু এর কারণে আবার নীপিড়নের সম্ভাবনাটাও বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, আমাদের আসলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। নারীদের জন্য নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে, অনেক নতুন নতুন দেশের জন্য গবেষণা হয়েছিল। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর, হংকং, জাপানসহ ইউরোপের কিছু দেশে। কিন্ত সেই মার্কেটগুলো আর এক্সপ্লোর হয়নি।
আসিফ মুনির বলেন, নারীদের সেক্টরভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বাসাবাড়িতে যারা কাজ করবে তাদের যোগ্যতাও জরুরি। ওখানকার বাসা বাড়ি আর আমাদের বাসা বাড়ি এক নয়। তারা যে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে, আমাদের দেশে যা ব্যবহার হয়, সেটা কিন্ত এক না। এজন্য এগুলো চেঞ্জ করা দরকার। ১০ বছরের একটা রোডম্যাপ হোক। তাহলে সমস্যা সমাধান হবে। না হলে নারী কর্মীদের সংখ্যা আরও কমবে।
আরএএস/এমএইচআর/এমএস