দুর্নীতি মোকাবিলায় কিছু পরামর্শ

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি একটি অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতা লাভের পর দেশ পুনর্গঠনের পথে যখন এগোচ্ছিল, তখন দুর্নীতির উপস্থিতি ছিল। তবে বর্তমানে দুর্নীতি সমাজের প্রতিটি স্তরে জেঁকে বসেছে এবং এটি দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য এক প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে দুর্নীতির বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেখানে সরকারি কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, এমনকি শিক্ষাঙ্গন এবং স্বাস্থ্যখাত পর্যন্ত এর সাথে জড়িয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সরকারি প্রকল্পে ব্যাপক লুটপাট, ভুয়া বিল পেশ, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় তদবির, ওষুধ বা চিকিৎসাসামগ্রীতে অতিরিক্ত দাম নির্ধারণ ইত্যাদি ঘটনা সাধারণ মানুষের সামনে প্রতিদিনই চলে আসে।
তবে দুর্নীতি শুধু ছোটখাটো ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। বরং বড় বড় দুর্নীতি কেলেঙ্কারি যেমন শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক লুটপাট, সড়ক দুর্ঘটনায় দায়ী বিভিন্ন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব অবহেলা, প্রভৃতি বিষয়গুলো বাংলাদেশে এক অবিশ্বাস্য দুর্নীতির চিত্র নির্মাণ করেছে।
উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি এবং ব্যাংক লুটপাটগুলোর কথা বলা যায়, যেখানে রাজনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে অনেকে মুনাফা লাভের জন্য এক্সেসিভ রিস্ক নিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থকে খর্ব করেছেন। আবার, স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির ফলে সাধারণ মানুষকে জীবন মরণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
দুর্নীতির উৎস মূলত অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার দুর্বলতা, প্রশাসনিক অযোগ্যতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে নিহিত। তাছাড়া, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই দুর্নীতি উত্থান পাচ্ছে।
ক্ষমতার অপব্যবহার: রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা কিংবা ব্যবসায়ীরা ক্ষমতার অজুহাতে দুর্নীতি করেন।
প্রশাসনিক দুর্বলতা: প্রশাসনিক পর্যায়ে ঘাটতি, অপর্যাপ্ত তদারকি এবং দুর্বল দমননীতি দুর্নীতির সূচনা করে।
জবাবদিহিতার অভাব: সুশাসন ও তদারকি ব্যবস্থার অভাব দুর্নীতির বীজ বুনে দেয়।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য দুর্নীতি মোকাবিলা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য কিছু পরামর্শ হতে পারে:
শক্তিশালী আইন প্রয়োগ: দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন তৈরি এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি। দুর্নীতিবাজদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।
শুদ্ধ প্রশাসন: প্রশাসনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিয়মিত মনিটরিং ব্যবস্থা তৈরি করা। দুর্নীতির ব্যাপারে প্রশাসনের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
শিক্ষা ও জনসচেতনতা: সাধারণ জনগণকে দুর্নীতির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা এবং একটি নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা। পাশাপাশি, শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা ও সুশাসনবিষয়ক পাঠ্যক্রম যুক্ত করা।
স্বচ্ছতা ও ডিজিটালাইজেশন: সরকারি সেবা ডিজিটালাইজ করার মাধ্যমে প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করা। ডিজিটাল মাধ্যমে কাজের অগ্রগতি ট্র্যাক করা এবং জনগণের কাছে তার রিপোর্ট প্রকাশ করা।
বিশ্ব থেকে উদাহরণ: সিঙ্গাপুরের সাফল্য
বিশ্বের মধ্যে সিঙ্গাপুর অন্যতম এক দুর্নীতি মুক্ত দেশ। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ, যার নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, দেশটির শুদ্ধ প্রশাসন গঠনে সফল হয়েছে। দেশটি র্যাঙ্কিংয়ে দুর্নীতি-হীনতার মধ্যে প্রথম দিকে অবস্থান করে।
সিঙ্গাপুরে সরকারি কর্মকর্তা ও নেতাদের জন্য রয়েছে অত্যন্ত কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। এটি একটি নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও মডেল হিসেবে কাজ করেছে। দেশটি শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন এবং আইন-ব্যবস্থায় দুর্নীতি রোধে নানা উদ্যোগ নিয়েছে, যার ফলে সিঙ্গাপুর বিশ্বব্যাপী এক দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে পরিচিত।
বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর সফলতার দৃষ্টান্ত:
এছাড়াও, হংকং এবং নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলোও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে সফলতা পেয়েছে। এসব দেশ তাদের আইনি ব্যবস্থা এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছে, যার ফলে দুর্নীতি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। হংকং, যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি স্বাধীন কর্তৃপক্ষ রয়েছে, সেখানে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় দ্রুত এবং কঠোরভাবে।
সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা
দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন:
শক্তিশালী কমিটি গঠন: দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একটি জাতীয় পর্যায়ের কমিটি গঠন করা যেতে পারে, যা প্রতিটি সরকারি প্রকল্প এবং প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবে।
আইন প্রবর্তন ও বাস্তবায়ন: দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইন কঠোর করা এবং এর কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করা।
স্বচ্ছতা এবং ডিজিটাল সেবা: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সরকারি সেবা সরবরাহ করে স্বচ্ছতা আনা। সকল সরকারি সেবার প্রক্রিয়া অনলাইন করা এবং পাবলিক রেকর্ড সহজলভ্য করা।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি: জনগণকে দুর্নীতি রোধে সচেতন করা এবং জনশক্তির মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি করা।
বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে: সরকারি প্রকল্পগুলোর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনিটরিং ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা ও বাজেট নির্ধারণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করতে হবে। প্রকল্পের কার্যকারিতা পর্যালোচনা করতে হবে জনগণের জন্য, যেন তারা জানে যে প্রকল্পগুলো তাদের কল্যাণে আসছে কি না।
পরিশেষ
বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা, কিন্তু তা চিরকাল থাকবে না। সঠিক পরিকল্পনা, আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং জনগণের সচেতনতার মাধ্যমে একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। বিশ্বে সিঙ্গাপুর, হংকং এবং নিউজিল্যান্ডের মত উদাহরণ আমাদের পথ দেখাতে পারে, যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরলসভাবে সংগ্রাম চলছে। তাই বাংলাদেশে যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে, তবে এটা সম্ভব, এবং সেজন্য আমাদের সবার উদ্যোগ এবং দায়িত্ব গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
[email protected]
এমআরএম/জিকেএস