ডিসেম্বরেই নির্বাচন

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় পরিপূর্ণ। ২৭ তারিখে অনুষ্ঠিত বিএনপি’র বর্ধিত সভায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ, তার আগে ২৫ তারিখে সেনাপ্রধানের বক্তব্য এবং সর্বশেষ ২৮ তারিখে নতুন রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয়- এই ক’টি ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ঘটনাগুলো থেকে একটি বিষয় সকলে নিশ্চিত হয়েছে যে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। উপরন্তু নির্বাচন কমিশনও একাধিকবার জানিয়েছে, নির্বাচন ডিসেম্বরে করা সম্ভব। সবমিলে ৫ আগস্টের(২০২৪) পর গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর বারংবার অনুরোধের একটি মীমাংসিত সিদ্ধান্ত জনগণের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে।

বলাবাহুল্য, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে ক্রমাগত অনুরোধ করা হচ্ছিল। সত্যিকার অর্থে দেশের উন্নতি সম্ভব নির্বাচিত সরকার দিয়ে। আর সত্যিকারে সংস্কার হতে পারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়। ২৩/২/২০২৫ তারিখে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং নির্বাচিত সরকারের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছেন-‘আমরা লক্ষ্য করছি যে, সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তির কথাবার্তা থেকে এবং বিভিন্ন ব্যক্তি আলোচনা থেকে ফুটে উঠছে যে- তারা সম্ভবত তাদের লক্ষ্য থেকে কিছুটা হলেও ক্ষেত্র বিশেষে বিচ্যুত হচ্ছে। আর বিভিন্ন ব্যক্তির বিবৃতিতে বিভিন্ন রকমের বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে, মানুষ বিভিন্নভাবে কনফিউজড হচ্ছে। খুব স্বাভাবিকভাবে রাজনীতিতে যখন কনফিউশন থাকবে, অস্থিরতা তখন দেখা দেবে। এই অস্থিরতার কারণে দেশের মানুষ সমস্যার সম্মুখীন হবে। কারণ যখনই রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকবে, রাজনৈতিক স্টেবিলিটি যদি আমরা নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে আমরা যে যতই সংস্কারের ঘোষণা করি না কেনো, কোনোটাই সফল হবে না।…রাজনৈতিক অস্থিরতা, তর্ক-বিতর্ক এবং আলোচনা বলুন, সেটিকে সংসদের মধ্যে নিয়ে আসা। সংসদই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ও মূল জায়গা, সেখানে রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্তÑ যাই হোক না কেনো, সেটি সংসদের মধ্যে হয়ে থাকে। আমরা সংসদকে কার্যকর করতে যত দেরি করব, এই অস্থিরতা, তর্ক ও বিতর্ক সংসদের বাইরে ছড়াতে থাকবে। তখন সকল জায়গায় একটা অস্থিরতা দেখা দেবে। যা সামগ্রিকভাবে দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সুতরাং দেশে দ্রুত একটা স্থিতি অবস্থা প্রয়োজন।’(মানবজমিন, ২৪/২/২০২৫) অর্থাৎ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত হলেই অরাজকতা থেকে আমাদের মুক্তি আসবে। জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে দিতে হবে। তা না হলে বর্তমান সরকারই একদিন জনগণের কাছে অভিযুক্ত হবে।

নির্বাচন দ্রুত না হলে অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে-এটা যেমন সত্য তেমনি সময়ক্ষেপণের কারণে নানা কর্নার থেকে সংকট ঘনীভূত হবে। জনগণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চায়। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে গত ১৬ বছর জনগণকে বঞ্চিত করেছিল। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করার সুযোগ পায়। নির্বাচিত সরকার জনগণের সংকট মোচনে আন্তরিক হতে বাধ্য। কারণ জবাবদিহিতার জন্য তাকে তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবেই। অবশ্য নির্বাচন শুধু একটা দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য নয়, নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যাওয়ার জন্য একটা পথ সৃষ্টি করা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটি রাষ্ট্রের মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশে এখন দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাস্তবতা সর্বত্রই দৃশ্যমান। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন হলে অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। তাহলে প্রশাসনে চেইন অব কমান্ড থাকবে, এখন কেউ কারও কথাই শুনছে না। সাধারণ জনতার অভিমত, নির্বাচিত সরকার এলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে তখন সবকিছু একটা নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে থাকবে।

যেহেতু সংসদ নির্বাচন ডিসেম্বরে হচ্ছে সেহেতু জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়াটাই সমীচীন। কারণ স্থানীয় পর্যায়ে গ্রুপিং, হানাহানি, মামলা-হামলা বেশি। ফলে ড. ইউনূস সরকারের জন্য পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হবে। সরকার বিতর্কিত হবে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার অপতৎপরতা জয়ী হবে। অন্যদিকে সরকারের ভেতরে থেকে যেসব ছাত্র রাজনৈতিক দল গঠনের পর ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে উৎসাহী হয়ে উঠেছে তাদের মনে রাখা উচিত রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। কারণ ভোটে নির্বাচিত সরকার দেখতে চায় জনগণ। যেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে সেখানে স্থানীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে স্থানীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে সক্ষম হবে। এই অভিমতের পক্ষে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি-দু’টি সংবাদ ভাষ্য তুলে ধরলেই যথেষ্ঠ।

২.
নির্বাচন অনিবার্য-এই বাস্তবতা এখন সর্বস্তরে উচ্চকিত। ‘কেউ কারও কথা শুনছে না, ভোট হলে ভালো’ শীর্ষক সংবাদ প্রতিবেদনে (দৈনিক মানবজমিন, ২৩/২/২০২৫) গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ- এই চারটি জেলার, বিভিন্ন উপজেলা, গ্রাম এবং শহর সরজমিন ঘুরে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের নানামুখী প্রতিক্রিয়া অনুসারে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে মতামত পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ মানুষের মত যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন হবে তত পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। রাজনৈতিক সরকার হলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে, এমনটা মনে করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পুলিশ, প্রশাসনসহ সরকারি নানা খাতে বিশৃঙ্খলার কারণে মানুষের মাঝে হতাশার চিত্র দেখা গেছে। মানুষ বলছে, ‘কোথাও কারও নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। কেউ কারও কথা শুনছে না।’

এজন্যই গত কয়েকমাস যাবৎ দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগাদা দিয়েছেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ। এর কারণ হলো- ড. ইউনূস সরকারের ছয় মাস অতিবাহিত হয়েছে এবং সামাজিক জীবনে নানা কর্নার থেকে অস্থিরতা দৃশ্যমান হচ্ছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়েছে। ফলে বড় রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত সংস্কার এবং দ্রুত নির্বাচনের তাগাদা দিচ্ছে অনবরত। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত ১৭/২/২০২৫ তারিখে বলেছেন, নির্বাচন যত দেরি হবে, দেশের সমস্যা তত বাড়বে। তার মতে, ‘দেশ পরিচালনার দায়িত্ব জনগণ ঠিক করবে, তারা কাদের (দায়িত্ব) দেবে। কাজেই এই বিষয় (নির্বাচন) যত দেরি হবে, আমরা মনে করি, বিভিন্নভাবে ধারণা করি, তাতে করে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।’ আড়াই বছর আগে বিএনপির দেওয়া ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের কথা তুলে ধরে তারেক রহমান আরো বলেছেন, ৩১ দফার মূল কথা হচ্ছে বৈষম্যহীন একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশের প্রত্যাশা প্রত্যেক মানুষের। যে বাংলাদেশে মানুষের রাজনৈতিক অধিকার থাকবে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকবে।…বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে একটি ‘জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার’ প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তারেক রহমান। তার মতে, ‘এ দেশের মূল মালিক বাংলাদেশের জনগণ। কাজেই বাংলাদেশের জনগণের সেই অধিকার আছে এই দেশ নিয়ে কী হবে না হবে, এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার। সমগ্র পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায়, সেটি হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণ তাদের মতামত ব্যক্ত করে থাকেন।’ এজন্য ‘আমরা জনগণের অধিকার যত দ্রুত জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারব, আমি বিশ্বাস করি তত দ্রুত আমরা দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হব।’

গত ২১/১/২০২৫ তারিখে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘ন্যূনতম যে সংস্কার, সেটা করে নিয়ে নির্বাচনটা করলে সমস্যাগুলো অনেকটা সমাধান হবে।’ তিনি ‘সমস্যাগুলো’ বলতে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর উদ্ভূত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। তার মতে, যেকোনো নির্বাচিত সরকার অনির্বাচিত সরকারের চেয়ে শতগুণে গ্রহণযোগ্য। ‘একটা নির্বাচিত সরকার পিপলস ম্যান্ডেট নিয়ে বসবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেরকম নয়, ওদের মধ্যে সেই কনফিডেন্স নাই। পিপলের ভাষাটা তো বুঝতে হবে। সেটা একটা নির্বাচিত সরকার সবচেয়ে ভালো বোঝে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’ (২১/১/২০২৫)।

৫ আগস্ট (২০২৪) অভ্যুত্থান পরবর্তী দেশের পরিস্থিতি গত ছয় মাসে ‘জোর যার মুল্লুক তার’-এ পরিণত হয়েছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি সেনাপ্রধান একই কথা তার ভাষণে প্রকাশ করেছেন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রকৃতপক্ষে নাজুক। রাস্তায় রাতের বেলা মানুষের চলাচলে খুবই সমস্যা হচ্ছে; চুরি, ডাকাতি বেড়ে গেছে। রাস্তায় পুলিশি টহল নেই। মাঝেমধ্যে সেনাবাহিনীর একটা দুটো গাড়ি রাস্তা দিয়ে আসে যায়। বিপদে পড়লে তাদের সহযোগিতা পাওয়া যায় না। রাতের বেলা বাসায় ফিরতে হয় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। অথচ নির্বাচিত সরকার থাকলে এই সামাজিক অস্থিরতা থাকত না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও সেই সরকার জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে সক্ষম হতো। বাহিনীগুলোর সদস্যরাও নিজেদের নিরাপদ মনে করবে। কারণ ছাত্র-জনতার ‘মব’ এখনো বহাল; পুলিশের উপর তাদের ক্ষোভ মেটানোর জন্য সুযোগ সন্ধানী অনেকেই। মানুষের নিরাপত্তা বিধানের জন্য নিরাপত্তা কর্মীর নির্ভীকভাবে অপরাধীকে প্রতিরোধ করার সক্ষমতা তৈরি হবে নির্বাচিত সরকার এলে।

এখনকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রেষারেষি বেড়েছে। যদি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, তবে তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় চলে আসবে। যেহেতু বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দুইটা বড় রাজনৈতিক দল, সুতরাং আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না গেলে তারাই হবে সরকারি এবং বিরোধী দল। তাই তাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে জনগণের অভিমত হলো-নির্বাচনে বিএনপি বা অন্য দল যারাই ক্ষমতায় আসুক অন্তত নিরাপত্তাটা ঠিকমতো পাওয়া যাবে বলে মনে হয়। এখন তো কোনো কিছুই ঠিক নেই। আল্লাহর ওয়াস্তে দেশ চলছে।

প্রকৃতপক্ষে এই সরকার রাজনৈতিক সরকার না হওয়ায় তৃণমূলে তাদের নিয়ন্ত্রণ নাই। সুতরাং তারা ব্যর্থ হলে ব্যক্তি হিসেবে দুর্নাম হবে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকার ব্যর্থ হলে দল হিসেব একটা বড় ধাক্কা খায়। তাই রাজনৈতিক সরকার দেশ পরিচালনায় সচেতন থাকে বেশি এবং সব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ থাকায় সিন্ডিকেট করাটা কঠিন হয়ে যায়। তাই দ্রুত ভোটদানের মাধ্যমে জনগণের সরকার গঠন হলে, টেকসই পরিবর্তন হতে পারে।

৩.
নির্বাচন হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি প্রকৃত প্রতিযোগিতা যেখানে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের নেতা নির্বাচন করতে পারে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তারা নিজেদের স্বার্থে কিংবা কর্তৃত্বে জনগণের ভোটাধিকার নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে পরিস্থিতি ভিন্নরূপ হতে বাধ্য। বিশ্বের অন্যান্য স্থানে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে গবেষণা করা গবেষকদের কাছে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলি কেন নির্বাচন করে তার আকর্ষণীয় ব্যাখ্যা রয়েছে এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা আমলে বাংলাদেশে কী ঘটছে তা বোঝার জন্য এই উত্তরগুলি কার্যকর। অস্ট্রেলিয়ান গবেষক Morgenbesser Zvi Behind the Façade: Elections under Authoritarianism in Southeast Asia, বইতে যুক্তি দিয়েছেন যে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় নির্বাচন কর্তৃত্ববাদী শাসকদের শাসন করার বৈধতা প্রদান করে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুপস্থিতির ফলে যে কোনও গণ-বিক্ষোভের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ভাগ্যবতী ছিলেন। আওয়ামী লীগের কিছু জনসমর্থন নিয়ে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন সত্ত্বেও নির্বাচন তাকে শাসন করার বৈধতা দিয়েছিল। ভারত, চীন এবং রাশিয়ার শক্তিশালী কূটনৈতিক সমর্থনের জন্য তিনি ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হন। সেসময়গুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা দেশগুলি নির্বাচনে কারচুপির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল কিন্তু সেই সমালোচনা জোরাল ছিল না এবং বিশে^র কিছু শক্তিধর সরকার অবশেষে হাসিনার সাথে কাজ করেছিল। অন্যায়-অবিচার থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন বাংলাদেশি শাসনব্যবস্থাকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতা প্রদান করেছিল। একটি উদ্ধৃতি স্মরণীয়- In Bangladesh, Hasina’s AL has some popular support and elections, despite being flawed, have bestowed her with a measure of legitimacy to rule. Thanks to strong diplomatic backing from India, China and Russia, Hasina had managed to remain in power through two flawed elections. Western countries, including the U.S., have raised concerns over the rigging of elections but such criticism was muted, and governments have eventually operated with Hasina. Therefore, elections provided Bangladeshi regimes with national and international legitimacy. (ডিপ্লোম্যাট, আমেরিকা, ২৯/১১/২০২৩)
কিন্তু ৫ আগস্টের (২০২৪) গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন ড. ইউনূস সরকার নির্বাচিত সরকার নন। ফলে তাদের কর্তৃত্ববাদী হওয়ার সুযোগ নেই। গণ-বিক্ষোভ দমনে মারমুখি হওয়ার কোনো কারণও নেই। এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের ভিজিটিং ফেলো শফি মোঃ মোস্তফা একটি মিডিয়ায় বলেছেন যে, যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেকে সংজ্ঞায়িত না করে, উদাহরণস্বরূপ সংস্কার প্রস্তাবের মাধ্যমে, তাহলে শীঘ্রই এটি বৈধতার সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। ‘এটি নিজেকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকার হিসেবে, অথবা একটি বিপ্লবী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।’ তার মতে, ‘অন্তবর্তীকালীন সরকারের ম্যান্ডেট কেবল নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।’ গবেষকদের মতে, ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে অপশাসনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ পুনরুদ্ধার করতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রস্তুতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন সহ একটি নির্বাচিত শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং স্থানীয় পর্যায়ে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।
আগেই বলেছি, বিএনপি’র অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বারবার একই কথা বলেছেন। সরকারের নানা তরফ থেকে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে কথা শুরু হলে আগে জাতীয় নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং পরে স্থানীয় নির্বাচন দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। (আজকের পত্রিকা, ১৫/২/২০২৫) অর্থাৎ ‘আগে জাতীয় নির্বাচন পরে স্থানীয় নির্বাচন।’ বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার বিপ্ল¬বের ফলে একটি জনসমর্থিত সরকার। এ সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, যেটাতে জনগণ ভোট দিতে পারবে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না। সরকার কি তবে আগামী নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে যাঁরা ক্ষমতায় আসবেন, তাঁদের বিশ্বাস করে না? এই অবিশ্বাসের কারণেই তো ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছিল, বাক্স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল, দেশের সম্পদ লুট করা হয়েছিল। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করুন এবং জনগণের নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন।’
৪.
বিএনপি বর্জিত ফ্যাসিস্ট সরকারের ৭ জানুয়ারি(২০২৪) নির্বাচনের পর অধ্যাপক-কলামিস্ট এবং বর্তমান সরকারের একটি সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রিয়াজ The Election in Bangladesh: What Happened and What Is in the Making?(11/1/2024) নিবন্ধে লিখেছিলেন, The coming months will be crucial for Bangladesh as the downward spiral toward a one-party state is likely to accelerate, economic conditions may worsen, disenfranchised citizens may become restive, and opposition parties facing an existential threat may take to the streets. Despite the West’s acceptance of the results as a fait accompli, considering China’s growing influence, tensions will continue. These developments will affect not only the country’s domestic politics but regional dynamics too. ( The National Bureau of Asian Research, 11/1/2024)
ড. আলী রিয়াজ যা বলেছিলেন তাই ঘটেছে। স্বৈরাচারী হাসিনার একদলীয় শাসন পুনরায় শুরু হয়েছিল। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে, ভোটাধিকার বঞ্চিত নাগরিকরা অস্থির হয়ে উঠতে থাকে এবং অস্তিত্বের হুমকির মুখোমুখি বিরোধী দলগুলি রাস্তায় নেমে আসে। এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয় হয়ে গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়। নির্বাচন কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেই নয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গতিশীলতাকেও প্রভাবিত করে- তারই দৃষ্টান্ত রয়েছে বাংলাদেশের বিগত নির্বাচনগুলোতে। ২০১৪ থেকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। অর্থাৎ বাংলাদেশের নির্বাচন কেবল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি, বরং বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়নের ক্ষেত্রেও একটি ইস্যু হয়ে উঠেছে। ভারত, চীন এবং রাশিয়া শেখ হাসিনা সরকারকে সমর্থন দিলেও আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো অবাধ, সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের দাবি করে এসেছে বরাবরই। ফলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দাবি জোরদার হয়ে উঠে। একদলীয় শাসন, হত্যা, গুম, নিপীড়ন গণমানুষকে প্রতিবাদী করে তোলে। (চলবে)

লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান এবং অধ্যাপক, থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Source link

Exit mobile version