
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির বিশেষ পরামর্শক টবি ক্যাডম্যান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিষয়টি নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) উত্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। জবাবে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘যেহেতু জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গত মাসে জানিয়েছিল যে, অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। তাই বাংলাদেশ শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেবে যে, তারা জুলাইয়ের নৃশংসতার বিষয়টি আইসিসিতে পাঠাবে কিনা।’
বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বসনিয়া, কসোভো, রুয়ান্ডা, ইয়েমেন, সিরিয়া ও ইউক্রেনে কাজ করা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ ক্যাডম্যান সাক্ষাৎ করতে এসে এমন সুপারিশ করেন। সাক্ষাৎকালে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে ঢাকা কীভাবে সম্পৃক্ত করবে, সে বিষয়টিও সামনে আনা হয় এবং বিস্তারিত আলোচনা হয় বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
আলোচনায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সম্ভাবনা এবং বাংলাদেশের ন্যায়বিচার অন্বেষণে আদালতের ভূমিকা ও দায়িত্ব নিয়েও আলোচনা হয়। এসময় বলা হয়, কিছু পলাতক অভিযুক্তকে বিদেশি রাষ্ট্র দ্বারা রক্ষা করার কারণে, পরিপূরক নীতির অধীনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সঙ্গে সহযোগিতা প্রয়োজন এবং যাতে অপরাধীদের পুরোপুরি জবাবদিহির আওতায় আনা যায়, তা নিশ্চিত করার জন্য দুটি প্রতিষ্ঠানের একসঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করা উচিত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার মধ্য দিয়ে এই সভা শুরু হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত নৃশংসতা, বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানের সময় যেসব নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছে, তার বিচারের দায়িত্ব এই ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া হয়েছে।
ক্যাডম্যান ‘পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী শাসন থেকে স্পষ্টভাবে প্রস্থান প্রদর্শনের জন্য’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোতে সংশোধনী আনার পরামর্শ দিয়েছেন, যার মধ্যে প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে। সুষ্ঠু বিচার ও যথাযথ প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করতে মৃত্যুদণ্ড এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের পদ্ধতিগত বিধি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়।
প্রফেসর ইউনূস আইসিটি প্রসিকিউশন টিমের কাজের প্রশংসা করে বলেন, সুষ্ঠু বিচার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তাদের অবশ্যই সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মান সমুন্নত রাখতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘জুলাইয়ের গণজাগরণের সময় ১ হাজার ৪০০ শিক্ষার্থী, প্রতিবাদকারী ও শ্রমিককে হত্যার নির্দেশ কে দিয়েছিল এবং কারা মূল অপরাধী ছিল; তা বিশ্বকে জানা উচিত। শেখ হাসিনার শাসনের আসল মুখোশ উন্মোচন করে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন চমৎকার কাজ করেছে। এখন আমাদের অবশ্যই অপরাধীদের জবাবদিহি করতে হবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
সভায় ট্রাইব্যুনাল এবং প্রসিকিউশনকে পূর্ণ সহায়তা সরবরাহের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয় যাতে সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়, অভিযুক্তরা ন্যায্য বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত মৌলিক অধিকার পায় এবং সত্য, ন্যায়বিচার এবং দীর্ঘস্থায়ী মীমাংসা লক্ষ্যে প্রক্রিয়াটিতে জনগণের পূর্ণ ও স্বচ্ছ প্রবেশাধিকার রয়েছে।
আলোচনার আরেকটি বড় বিষয় ছিল আগের সরকারের চুরি করা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা। সভায় অংশগ্রহণকারীরা এসব সম্পদ পুনরুদ্ধার ও বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি ও পদ্ধতিগত ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। বৈঠক শেষে প্রফেসর ইউনূস ক্যাডম্যানকে ‘আর্ট অব ট্রায়াম্ফ: গ্রাফিতি অব বাংলাদেশ’স নিউ ডন’ বইয়ের একটি কপি উপহার দেন, যা বাংলাদেশের নতুন যুগের আশা ও সহনশীলতার প্রতীক।