
ছোট্ট ঘরে একসঙ্গে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার মো.মাসুম মিয়া ও রিনা বেগম। ২০০৫ সালে বিয়ে। বিয়ের দুই বছর পর তাদের সংসারে এলো একটি পুত্র সন্তান। সে বছর ‘সিডর’ হলো। সিডরের ঠিক আগের দিন জন্ম নেয় শিশুটি। মায়ের নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে ছেলের নাম রাখা হয় ‘রিমন’। রিমনের জন্ম খুশিতে সিডরের ক্ষতিও অনুভব করেনি মাসুম-রিনা। সুখ এলো সংসারে। বেশ ভালোই চলছিল সবকিছু।
একসময় পরিবারের প্রয়োজনে জেলে কাজ শুরু করেন মাসুম। এর কিছুদিন পর একটি ঝড় তাদের স্বাচ্ছন্দ্যকে স্তব্ধ করে দেয়। বঙ্গোপসাগরে ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ হন মাসুম। সেই থেকে শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। মাসুমহীন রিনা-রিমনের জীবনযুদ্ধ।
২০১৮ সালের ২১ জুলাই-সমুদ্রে অবস্থান করছিল মাসুমদের ট্রলার। এর ঠিক দু-দিন আগে উপকূল ছেড়ে যায় ট্রলারটি। যাত্রাকালে বলে গিয়েছিলেন, ‘এবার ৬-৭ দিনের মধ্যেই ফিরবেন’। তবে গত ৬ বছরেও আর ফেরেননি। সেই ট্রলার থেকে বেঁচে ফেরা জেলেরা জানালেন, ঝড়ে ট্রলারটা উলটে যায়। এরপর একটা বাঁশ ধরে ভাসছিলেন ছয়জন। একসময় পানির ঘোলে (স্রোতের তোড়ে) মাসুম তলিয়ে গেলেন। আর উঠতে পারেননি। এরপর আর কেউ তাকে দেখেনি।
এমন নিখোঁজ জেলেদের সন্তান নিয়ে চরম বিপাকে পরেন জেলে পরিবারের নারীরা। পরিবার বাঁচানোর হাল ধরতে হয় জেলেবধূর। মাসুম নিখোঁজের পরে রিনাকেও করতে হয়েছে তেমনই অবর্ণনীয় কষ্ট। পাথরঘাটার পূর্ব বাদুরতলা গ্রামে রিনার নানা বাড়ি। স্বামী নিখোঁজের পর এখানেই থাকতে হচ্ছে। এখন রিনা অসুস্থ, তবুও ফেরি করে মাছ বিক্রি করেন। কৃষি কাজ করেন। রিনা বেগম পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। অভাবের কারণে এরপর আর লেখাপড়া এগোয়নি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে, ১৮তে হলেন মা, ২৬ বছর বয়সে হারাতে হলো স্বামীকে। বর্তমানে তার বয়স ৩২। অর্থাৎ ১০ বছরের সংসার জীবন, এরপর গত ৬ বছর ধরে স্বামীহারা রিনা।
রিনা জানালেন, গত ছয়টি বছরে তার প্রতিটি দিন কেটেছে স্বামীর আশায়-চাহিদায়। দেহে বিষধর সাপের বিষ বয়ে বেড়ানোর মতোই ছিল দিনগুলো। তবু তিনি ধৈর্য ধরেছেন। ছেলেকে বড় করার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়েছেন। সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য তিনি হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছেন।
গ্রামীণ স্বামী পরিত্যক্তা কিংবা বিধবারা বৃদ্ধা না হলে, সামাজিকভাবে নানা সমস্যায় পড়েন। অনেক কু-প্রস্তাবের সম্মুখীন হন। রিনাও হয়েছেন। দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছেন। অসামাজিক বুলিং মানতে হয়েছে বারবার। অপয়া নামক খেতাবও শুনতে হয়েছে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রস্তাবে খারাপ পথে যাওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু যাননি। গ্রামের মানুষরূপী শেয়ালগুলো থেকে নিজেকে রক্ষা করেছেন। স্বামীর অপেক্ষা করেছেন ‘হয়তো ফিরবেন কোনো দিন’। এই অপেক্ষা মৃত্যুক্ষণ পর্যন্ত বয়ে বেড়াবেন রিনা, আপত্তি নেই তাতে।
রিনা বলেন, ‘আমার যখন দেড় বছর বয়স, তখন আব্বায় মাকে তালাক দিলো। এরপর থেকেই কষ্ট শুরু। ছোটবেলা থেকেই কষ্ট করে বড় হয়েছি। ভাবছিলাম, বিয়ের পরে সুখ আসবে। ছেলের জন্মের পর মনে হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা বুঝি মুখ তুলে তাকাইছে। কিন্তু সুখ বেশিদিন কপালে টিকল না। স্বামী নিখোঁজের পর সন্তানটাকে নিয়ে ফের কষ্টের জীবন শুরু হলো। অভাব-অনটন নিয়েই চলতে হয়েছে। অনাহার-অর্ধাহারে থাকতে হচ্ছে।’
রিনা বলছিলেন, ‘গত ঈদের আগে অন্যের সাহায্যের টাকায় ছেলের জন্য শেষ জামা কিনেছিলাম। এখন নিজেরও একটু চিকিৎসা প্রয়োজন, ছেলের পড়ালেখার খরচ আছে, পেটভরা খাবারের ব্যবস্থা করাটাও এখন কঠিন। বড় অভাবে কাটে জীবন। নিখোঁজের পর প্রথম ২ বছর মাসে মাসে চাল পেয়েছি। এরপর আর পাইনি। সত্যিই আমি বিধবা কি না জানি না, তবুও স্থানীয় মেম্বারের দয়ায় বিধবা ভাতা পাই। এভাবেই চলে।’
জীবন নির্বাহে কতটা কষ্ট সইতে হয়েছে, তা রিনা জানেন। চোখের পানিতে কষ্ট কীভাবে ভাসাতে হয়, তাও রিনা বোঝেন। কিন্তু ছেলেটার চোখে বাবার অভাব তিনি সইতে পারেন না। সেই অভাব দেখে বারবার রিনা কাঁদেন। উপায় কি-এ যে নিয়তি, রিনা মেনে নিয়েছেন। এসব সয়ে ক্লান্ত তিনি। কিন্তু মনোবল হারাননি। ভেবে নিয়েছেন, এই সন্তানই সম্পদ। স্বামী নেই তো কী? সন্তান তো আছে। এত কষ্ট, সব সমাপ্ত হবে সন্তানের বিজয়ে।
সন্তানের বিজয়ের লক্ষ্যেই এগুচ্ছেন রিনা। মাসুম-রীনা দম্পতির সেই রিমন এখন ১৭ বছরের কিশোর। পাথরঘাটার বারি আজাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র সে। বাবা চলে গেলেন তখন রিমন ছিল চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া। সেই থেকে আজ অবধি রিমনকে সইতে হয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। মায়ের পাশাপাশি তাকেও বইতে হয়েছে কষ্টের ঘানি। বাবা না থাকায় নিরানন্দ আর প্রাপ্তিহীন জীবন কাটাতে হয়েছে ছোটবেলা থেকে। শিশুকালেই রিমনকে বুঝতে হয়েছে- নিখোঁজ জেলের সন্তানদের কোনো স্বাদ-ইচ্ছা-প্রয়োজন থাকতে নেই।
রিমনের জীবনটা কঠিন। মায়ের খাটুনি দেখলেই তার ইচ্ছে হয়, পড়ালেখা ছেড়ে কাজে জড়াতে। তবুও স্বপ্ন দেখে সে। সেনাবাহিনী, পুলিশ কিংবা নৌবাহিনীতে চাকরির ইচ্ছা তার। এই ইচ্ছাশক্তি শেষ অবধি বজায় থাকবে কি না, সেই সংশয়ও আছে। মায়ের দায়িত্ব নিতে হবে, পরিবারের হাল ধরতে হবে, ঋণ পরিশোধ করতে হবে, কতো কতো চিন্তা-দুশ্চিন্তা তার। এমন সময় বাবা পাশে থাকলে হয়তো জীবন অন্যরকম হতে পারত। তবে বিধাতা তা চাননি।
রিমন বলেন, ‘বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর অনেকের দান-সহযোগিতায় পড়ালেখা চালিয়েছি। আমাকে পড়াতে মা অনেক কষ্ট করেন। এসব দেখলেও কষ্ট লাগে। আমি মায়ের জন্য কিছুই করতে পারছি না। শুধু নিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন!’
শুধু রিনা-রিমন নয়। মাসুমের মা পাখি বেগম এখন মাছের আড়তে কাজ করেন। বাবা মো. সিদ্দিকুর রহমান ভিক্ষা করেন। মাসুমের বাবা-মায়েরও এমন দিন দেখতে হবে তা কল্পনায় ছিল না। ছেলে থাকতে কত স্বচ্ছন্দেই না ছিলেন তারা! একজন জেলের মৃত্যু-নিখোঁজে একটি পরিবারের কী অবস্থা হতে পারে সেই উদাহরণ এই মানুষগুলো।
জেলে জনপদে এমন পরিবার মিলবে আরও অনেক। যেন সব শেষ হয়, সবকিছু শেষ হয়, একটি নিখোঁজে। সেই শেষ থেকে নতুনভাবে শুরু করেন জেলেবধূরা। নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও নারীরা স্বামীর সংসার রক্ষা করেন। পরিস্থিতি এসব নারীদের শক্ত-দক্ষ করে তোলেন। ঘরে-বাইরে শ্রমে-ঘামে নারীরাই পরিবারের প্রাণ হয়ে ওঠেন। আর ঐ নারীর প্রাণ যেন ‘স্বামীর ঘর’।
আরও পড়ুন
কেএসকে/এমএস