Status

জামায়াতের কব্জায় স্বাস্থ্যখাত

দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারছে না স্বাস্থ্যখাত। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের ১৫ বছরে আওয়ামী সিন্ডিকেটের দখলে ছিল পুরো খাতটি। আওয়ামী সিন্ডিকেট থেকে মুক্তি মিললেও এখনো নতুন করে জামায়াত সিন্ডিকেটে বিপর্যস্ত স্বাস্থ্যখাত। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম একজন সৎ ও দক্ষ মানুষ হলেও তার অসুস্থতা ও নানা কৌশলে জামায়াত নিজেদের লোকজনকে বিভিন্ন পদে পদায়ন এবং আগের আওয়ামী সিন্ডিকেটকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বা বড় অঙ্কের বাণিজ্যের বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন বা বহাল রাখছে।

মোটকথা, স্বাস্থ্য খাতের ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে চিকিৎসকদের বদলি, বড় বড় পদে পদায়নে অবাধ ঘুষ লেনদেনের অজস্র অভিযোগ রয়েছে। মহাপরিচালক থেকে শুরু করে সহকারী পরিচালক এমনকি কর্মচারী সবক্ষেত্রেই জামায়াতীকরণ। আর নতুন সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে গত ১৫ বছরে যারা আওয়ামী দুঃশাসনে নানাভাবে বঞ্চিত তারা এখনো বঞ্চিতই থাকছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ এর অধীন দফতর ও প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তার ওপর এ সিন্ডিকেট অসন্তুষ্ট হলেই তার কপাল পুড়ছে। তাদের ‘সুদৃষ্টি’ ছাড়া চিকিৎসকদের কোনো পদায়ন বা পদোন্নতি হচ্ছে না। এই সিন্ডিকেটকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টার একান্ত সচিব (উপসচিব) ড. মোহাম্মদ মঞ্জুরুল ইসলাম।

তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তার সহযোগী বা কালেক্টর হিসেবে আছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ব্যক্তিগত সচিব তুহিন ফারাবি ও ডা. মাহমুদ। হাসিনার পতনের পর এই দু’জনকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ১০ম গ্রেডে বিশেষ ক্ষমতায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যারা মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের কার কোথায় পদায়ন বা পদোন্নতি হবে তা নির্ধারণ করেন। এক্ষেত্রে তাদের মুখ্য বিষয় জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অগ্রাধিকার এবং অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী দোসরদের বহাল তবিয়তে বা নতুন নতুন পদে পদায়ন। সূত্র মতে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা ভারতে পলায়নের পরপরই একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন ৫১ শতাংশ চিকিৎসক তাদের হতে হবে। আর এর পর থেকেই জামায়াত ইসলাম স্বাস্থ্যখাত নিয়ে সেভাবেই পরিকল্পনা করে। শুরুতেই স্বাস্থ্য উপদেষ্টার একান্ত সচিব (উপসচিব) হিসেবে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বা জামায়াতের রোকন ড. মোহাম্মদ মঞ্জুরুল ইসলামকে নিয়োগ দেয়া হয়। পরবর্তীতে তার হাতকে শক্তিশালী করতে আরো দুই শিবির কর্মী তুহিন ফারাবি ও ডা. মাহমুদকে ১০ম গ্রেডে বিশেষ ক্ষমতায় নিয়োগ দেয়া হয়। আর তাদের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী সুবিধাভোগীদের পুনর্বাসন শুরু হয়। আওয়ামী লীগের সময়ে নিয়োগ হলেও তৎকালীন সৎ, মেধাবী ও দক্ষ মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম পদত্যাগ করলে গত ১৮ আগস্ট তার নিয়োগ বাতিল করে এই জামায়াত সিন্ডিকেট ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় আওয়ামী সুবিধাভোগী ওই সময়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (এনসিডিসি) শাখার লাইন ডিরেক্টরের দায়িত্বে থাকা প্রফেসর ডা. রোবেদ আমীনকে। ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এনসিডিসি লাইন ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। শুধুমাত্র চটগ্রামে বাড়ি দেখিয়ে জামায়াত সিন্ডিকেট বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় তাকে।

অবশ্য বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব)-এর আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১২ সেপ্টেম্বর ডা. রোবেদ আমীনকে ওই পদ থেকে সরাতে বাধ্য হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রথমে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. নাজমুল হোসেনকে এই পদে বসানো হয়। পরবর্তীতে গত ১৫ অক্টোবর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের প্রফেসর ডা. মো. আবু জাফরকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবে দেয়া হয়। প্রফেসর ডা. মো. আবু জাফর ভারপ্রাপ্ত থাকাকালে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত গত ১৫ বছরে বঞ্চিত চিকিৎকদের পক্ষে থাকলেও এরপর ভারমুক্ত হয়ে মহাপরিচালক হিসেবে ১ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। আর এরপর থেকেই পুরোদস্তুর জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছেন। এখন আর তিনি বঞ্চিতদের পক্ষে নয়; জামায়াতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্যখাতের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে ইনকিলাবকে বলেন, এই মুহূর্তে স্বাস্থ্য অধিদফতরে যারা আছেন, দু’-একজন বাদে তাদের সবাই জামায়াতের লোক। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) শেখ সাইদুল হক এক সময়ে আওয়ামী সুবিধাভোগী ছিলেন। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আফম রুহুল হকের লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এমনকি এই পদে তার অভিজ্ঞতাও শূন্য।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) পরিচালক প্রফেসর ডা. মো. জিয়াউল ইসলাম এতোদিন আওয়ামী দোসরদের সহায়তা করে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করলেও হঠাৎ করে তিনি আসল রূপে ‘জামায়াতে’ ফিরেছেন। অথচ স্বৈরাচার হাসিনার সময়ে গত জুনে তিনি সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশনের (সিএমই) পরিচালক পদে বসেন। ডা. মো. জিয়াউল ইসলাম আওয়ামী লীগের সময়ে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমানের ভাতিজা হিসেবে পরিচয় দিতেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সময়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (শিক্ষা) এবং নিপসমের সাবেক পরিচালক ডা. বায়েজীদ খুরশীদ রিয়াজের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

পরিচালক প্রশাসন ডা. এ বিএম আবু হানিফ একজন আওয়ামী সুবিধাভোগী হয়ে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় এই পদে বসেছেন। আওয়ামী লীগ আমলে তিনি রংপুর হাসপাতালের পরিচালক পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন। অবশ্য বর্তমানে তিনি একাই পরিচালক প্রশাসন ও পরিচালক (হোমিও ও দেশজ চিকিৎসা) দুটি পদ ভোগ করছেন। এছাড়া বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পরিচালক ডা. দেলোয়ার হোসেনও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট (এইচ এস এম) বিভাগের লাইন ডিরেক্টর হিসেবে থাকা ডা. জয়নাল আবেদীন টিটু জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। একইভাবে খুলনা মেডিক্যাল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ডা. গোলাম মাসুদ। যিনি আওয়ামী লীগের সময়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ উপ-পরিচালক (পার-১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মোটকথা, অধিকাংশ পরিচালক, লাইন ডিরেক্টর, বিভাগীয় প্রধান, উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালক, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজাররা হয় জামায়াত না হয় তাদের আশীর্বাদপুষ্ট।
শুধু চিকিৎসকদের মধ্যে জামায়াতীকরণ নয়; টেকনোলজিস্টদের একটি গ্রুপ এখন স্বাস্থ্য অধিদফতরকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। নিপসম, ক্যান্সার হাসপাতাল, জাতীয় রোগ তত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে (আইইডিসিআর) তারা চাকরি করছেন। পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাতের বড় বড় পদে নিয়োগেও ভূমিকা রাখছে। একটি গ্রুপ হয়ে বিভিন্ন জনকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করছে গ্রুপটি।

এদিকে জামায়াত চক্রের হাতে স্বাস্থ্যখাত চলে যাওয়ায় অনেকটা বিপর্যস্ত। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দ্বৈনন্দিন কার্যক্রম নবাদ দিয়ে দলবাজি, বদলি ও পদায়নে ব্যস্ত তারা। আর তাই চলতি অর্থবছরের কোনো অপারেশন প্লান এখনো পাস করতে পারেনি। কারণ অধিকাংশ কর্মকর্তার এ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। তাই স্বাস্থ্যখাতের কার্যক্রমে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। যা আগামী দিনে স্বাস্থ্যখাতকে বিপাকে ফেলবে বলে মত একাধিক কর্মকর্তার। অবশ্য যার প্রভাব ইতোমধ্যে চলতি অর্থ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ফুটে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি কমানো হচ্ছে স্বাস্থ্যখাত থেকে। স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ থেকে ইতোমধ্যে ছেঁটে ফেলা হয়েছে ৫৯ শতাংশ। অথচ উন্নয়ন বরাদ্দে স্বাস্থ্যখাতকে অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখার বহু দিনের। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতোই এখনো এই খাতেই বেশি ছেঁটে ফেলা হয়েছে।

বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান বলেছেন, জামায়াত সব দখল করছে। ব্যাংক, হাসপাতাল, বিশ^বিদ্যালয়সহ সব প্রতিষ্ঠান দখল করেছে। জামায়াতের কথা ছাড়া চলে না প্রশাসন। বিএনপির এই বর্ষিয়ান নেতা বলেন, আমি ৫ আগস্টের পরই বলেছি, জামায়াত ইসলামের চরিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সুন্দরভাবে তারা এগুচ্ছে। তারা এখন ফ্র্যাঙ্কেস্টাইনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যে তাকে আশ্রয় দিয়েছে তাকে খেয়ে ফেলছে। ২০১৮ সালে দাড়ি পাল্লা মার্কা ছিল না। বিএনপি তখন ধানের শীষ মার্কা দিয়েছিল। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বিএনপির আশ্রয় নিয়ে রাজনীতি করেছেন। এখন বলছেন, নৌকা-ধানের শীষ, দুই সাপের একই বিষ। অথচ একসঙ্গে চললে কি হতো? জামায়াতকে উদ্দেশ্য করে বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান বলেন, আপনারা ভালো হন।

 

Source link

Back to top button