জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই

দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাতীয় ঐক্য ও সংহতির বিকল্প নেই। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রাম সফল হলেও দেশপ্রেমিক শক্তির মাঝে অনৈক্যের সুর জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছে। ‘ইসলাম’ এ দেশের জনতার প্রাণের আদর্শ, ঐক্য ও সংহতির ভিত্তি। এতদসত্ত্বেও সর্বত্র কেন আজ বিভক্তি ও অনৈক্যের সুর? জাতীয় নেতৃত্বের অনৈক্য আজ দেশপ্রেমিক জনতার মাঝে হতাশার জন্ম দিচ্ছে। তারা তাদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সঠিক নেতৃত্বের অভাবে ভুগছে। অপেক্ষা করছে শেরেবাংলা, মাওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শহীদ জিয়া, মেজর জলিল, ওসমানী, শহীদ তিতুমীর, হাজী শরিয়তুল্লাহর মত সাহসী নেতৃত্ব ও বীর সেনানীর বিপ্লবী আহবানের। অপেক্ষা করছেন কখন ডাক আসবে দেশ গড়ার, সমাজ গড়ার। দেশবিরোধী রাষ্ট্রদ্রোহী শক্তি যুগে যুগে জনগণের ঐক্যের ভিত্তিকে ধ্বংস করতে জাতির মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টির সূক্ষ্ম প্রয়াস চালিয়ে আসছে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বরা ষড়যন্ত্রকারীদের পাতানো জালে নিজেরই জান্তে এবং অজান্তে জড়িয়ে পড়েন। জাতীয় নেতৃবৃন্দ নিজেদের অনৈক্যের বীজ জনতার মাঝে ঢুকানোর কাজে বেশি শ্রম দিচ্ছেন। এতে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি অত্যন্ত দুর্বল পর্যায়ে অবস্থান করছে এবং ষড়যন্ত্রকারী মহল ভেতর থেকে দুর্গ দখলের পাঁয়তারা করছে। পর¯পর কাদা ছোড়াছুড়ির কারণে বৃহত্তর ঐক্যের সম্ভাবনা গড়ে উঠছে না। জনগণ জাতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে এখন যে বক্তব্য আশা করছে, তা হল, ‘আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য এবং ইসলাম ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের স্বার্থে পার¯পরিক বিরোধ থেকে সরে দাঁড়াই। দলমত নির্বিশেষে সকল ধর্মপ্রাণ মানুষের সাথে আন্তরিকতা ও আপস করে জীবনযাপন করি। আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম-সাধনা ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করি। এ ধরনের একটি ঐতিহাসিক ঘোষণার মাধ্যমে এদেশের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধ হোক- এটাই আজ জাতির প্রত্যাশা, নিশ্চয়ই। এটাই দেশের সিংহভাগ মানুষের একমাত্র মনোকামনা। এতেই শুধু আল্লাহর রহমত আসতে পারে এবং স্বাধীনতা, দেশ ও জাতির শত্রুরা পরাভূত হতে পারে। পাক কোরআনের ভাষায় বলা যায়, ‘এবং তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর এবং পর¯পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ এ নির্দেশের অনুবর্তী হয়েই ঈমানদাররা ইসলামের দুশমনদের সৃষ্ট বিভিন্ন অশুভ ফাটল দূর করতে সক্ষম হতে পারে। একটি রক্তক্ষয়ী জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও আমাদের জাতীয় ঐক্যের ভিত এখনও দুর্বল রয়ে গেছে। বৃহৎ দলগুলোর মাঝে এখনও জাতীয় ঐকমত্য গড়ে উঠেনি। কেউ চায় সংস্কার, কেউ চায় নির্বাচন। দুইটি দাবির মাঝে সমন্বয় খুবই দরকার। অপরদিকে ইসলামী দলগুলোর মাঝেও জোরালো ঐক্য দৃশ্যমান নয়। ইসলামের কোন কোন ছোট দিককে নিয়ে ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে মতদ্বৈধতা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এ বিরোধকে তীব্রতর করতে এবং অনৈক্যের বীজ বপনের জন্য বিরোধী শক্তিগুলো নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে; আজকে যেসব বিষয়কে তিল থেকে তালে পরিণত করা হয়েছে তা এখানে আলোচনা করতে গেলে হাসির চাইতেও দুঃখ এবং কান্নায় হৃদয় ভারাক্রান্ত হতে হয়। ইসলামী শক্তির মাঝে মতানৈক্যের ভিত্তিগুলো হলো: (১) ওহাবী, সুন্নী, দেওবন্দী-খারেজী. বেরলভী, মাজহাবী, লা মাহাজাবী ইত্যাদি, (২) রাসূল (সা.) মাটির মানুষ না নূরের মানুষ? (৩) রাসূল (সা.)-এর শানে মিলাদুন্নবী হবে, না সীরাতুন্নবী হবে? (৪) দরুদ বসে পড়া, দাঁড়িয়ে পড়া, (৫) টুপি লম্বা হবে, নাকি গোল হবে? (৬) সূরা ফাতেহার শেষাংশে ‘দোয়াল্লিন’ হবে না ‘জোয়াল্লিন’ হবে? (৭) আমীন বড় করে পড়বে, না মনে মনে পড়বে ইত্যাদি ইত্যাদি, যা দেখে ও শুনে নতুন প্রজন্ম, আধুনিক শিক্ষিতরা ইসলামের প্রতি এক প্রকার অনীহায় ভুগছে এবং ইসলামী ঐক্যের ভিতও দুর্বল হচ্ছে মারাত্মকভাবে।
দ্বীনের এ ক্ষতির জন্য কারা দায়ী? চলুন আজ আত্মসমালোচনা করি। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলামী জীবনদর্শনে ঐক্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কোরানের পরিভাষায় এ ঐক্যকে বুনইয়ানুম মারসুস বা ‘সীসার প্রাচীর’ ও ‘উরওয়াতুল উসকা’ বা ‘অবিচ্ছেদ্য বাঁধন’ বলা হয়েছে। রাসূল (সা.) সমগ্র মুসলিম জাতিকে একটি দেশরূপে চিত্রিত করেছেন। আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মুসলমান ভাইদের পার¯পরিক সমস্যাসমূহের বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং পার¯পরিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা। পার¯পরিক সমন্বয়, ঐক্য, সহযোগিতা ও সংহতি আনয়নের ক্ষেত্রে একটা দৃঢ় ও স্থায়ী ভিত্তি রচনা করা।
ইসলাম যে ঐক্য এবং সংহতির ধর্ম, তা কি আমাদের প্রদেয় ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ প্রতিভাত হতে দিচ্ছেন? জাতিসত্তার মাঝে ঐক্যের বীজকে সুদৃঢ় করে যারা জাতিকে ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে নিয়ে যাবেন, তারাই যখন অনৈক্যের বীজ ছড়ান, পরস্পর স্বাধীনতা বিরোধী, গুপ্তদল, অনৈসলামিক দল ইত্যাদি ফতোয়া প্রদানে ব্যস্ত থাকেন, তখন এজাতির জন্য দুর্ভাগ্যের আর কি বাকী থাকতে পারে? মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ-বিভক্তি জিইয়ে রেখে জাতীয় উন্নতিতে এদেশের আলেম সমাজ বা জাতীয় নেতৃবৃন্দ কোন অবদান রাখতে পারবেন, এটা কীভাবে বিশ্বাস করা যায়? পার¯পরিক খুঁটিনাটি বিরোধ-বিবাদকে পরিহার করে শুধুমাত্র এক কালেমায় বিশ্বাসী জনতাকে কি ঐক্যবদ্ধ করা যায় না? অথবা নিজ নিজ বিশ্বাস ও অবস্থান থেকে অন্যান্য মুসলমান দলের সাথে তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স¤পর্কের ক্ষেত্রে ইসলামের সুমহান স্বার্থকে তো সমুন্নত রাখা যায়।
এ প্রসংগে আল কোরআনে আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন, ‘এই যে তোমাদের জাতি, এতো একই জাতি এবং আমিই তোমাদের প্রতিপালক, অতএব (একমাত্র) আমারই ইবাদত কর’ (আল-কোরআন, ২১ : ৯৯)। এভাবে আমরা সকলেই শত্রুদের মোকাবিলায় একটি ‘অভেদ্য দুর্গ’ রচনা করতে পারি। দেশের শত্রুরা বিভিন্ন ইস্যুর নিশান উড়িয়ে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে, চালাবেÑ এটাই স্বাভাবিক। দেশপ্রেমিক জনতার ঐক্য ও সংহতি স¤পর্কে জনগণকে সচেতন করে তাদের বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতৃবৃন্দ, শ্রদ্ধেয় ইসলামী চিন্তাবিদ, পন্ডিত ও দ্বীনি ব্যক্তিত্বরা সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারেন। এব্যাপারে তাদের কথা ও কাজের মিল দ্বারা জনগণ বেশি প্রভাবিত ও আন্দোলিত হবে। নিজেদের মধ্যে অমিলের চেয়েও মিলের ক্ষেত্র খুঁজলে অনায়াসেই ঐক্য ও সংহতির ভিত রচিত হয়ে যেতে পারে। অমিলগুলোকে বড় করে দেখার কারণেই মিলের ক্ষেত্রগুলো আজ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়া রুখতে না পারলে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এ প্রসংগে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ঘোষণা, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে ও নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না, তা করলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে। তোমরা ধৈর্য ধারণ করবে। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন।’ (আল কোরআন ৮:৪৬) কোরআনের পবিত্র আয়াতটির প্রথমাংশে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং আল্লাহ রাসূলের প্রতি আনুগত্যের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে, আল্লাহ্র আনুগত্য করলে মুসলমানরা পর¯পর বিবাদ করবে না, এতে তাদের শক্তি ক্ষয় হবে না এবং তাদের মর্যাদাহানি ঘটবে না। নইলে ধ্বংস অনিবার্য।
আর ঐক্যের ব্যাপারে ধৈর্য্যের ও সহনশীলতার পরিচয় দিলে আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকবেন। জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি ছাড়া এদেশের মানুষের মুক্তি অসম্ভব। ইসলাম এ জাতির বৃহত্তর ঐক্যের চাবিকাঠি। এদেশের সকল মুসলমান বিশ্বাস করে- ১। এক কালেমায় (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূল্লাহ), ২। পাক কোরআন ও সুন্নায়, ৩। এক কেবলা বা বায়তুল্লাহ এবং (সামর্থ্যবানদের হজ্বে), ৪। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও রমজানের রোজায়, ৫। জিহাদ তথা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমবেত সংগ্রামে, ৬। সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের বাধার নীতিতে। উপরের ৬টি নীতির উপর ভিত্তি করে এদেশের তৌহিদী জনতার বৃহত্তর ঐক্য মঞ্চ রচিত হতে পারে। উল্লেখিত নীতিগুলো ছাড়াও ইসলামী নেতৃবৃন্দ ও জনতার মধ্যে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতৈক্য রয়েছে। যেমন : ১। ইসলামী সরকার, ২। সুদবিহীন শোষণমুক্ত ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা, ৩। স্বাধীনতা-দেশপ্রেম, ৪। সমরনীতি, ৫। সামাজিক স¤পর্ক, ৬। আন্তর্জাতিক আইন, ৭। শিক্ষানীতি ইত্যাদি।
সময় অনেক পেরিয়ে গেছে। দেশ ও জাতিকে অনেক কিছু দেয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধারের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতৃবৃন্দের সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে আরেকটি গোলামী যুগের অভ্যন্তরে জাতি প্রবেশ করতে পারে, যা থেকে বেরিয়ে আসতে আবার বহুযুগ পার হয়ে যেতে পারে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও ইসলামী ব্যক্তিত্বদের কাছে আকুল আবেদন, আর কালক্ষেপণ নয় এ মুহূর্তেই ঐক্যের ভিত রচনা করুন। নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজ নিজ অবদান রাখুন।
কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি না করলে পৃথক মঞ্চ থেকেও একই সুরে কথা বলে ঐক্য সাধনে বিরাট অবদান রাখা যায়। ঐক্য প্রয়াসী জনতা প্রতিহিংসাপরায়ণ নেতৃত্বের ডাকে সাড়া দিতে প্রস্তুত নয়। তারা সমুদ্রের মত উদার ও বড় মাপের মহান নেতৃত্বের আগমনের অপেক্ষায় দিন গুনছে। মুসলমানদের মধ্যে সংহতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গাফিলতির চরম মূল্য দুনিয়া ও আখেরাতে মুসলিম নেতৃত্বকে অবশ্যই দিতে হবে। স্বয়ং আল্লাহর ঘোষণা, ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা তাদের নিকট ¯পষ্ট নিদর্শন আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।’ (আল- কোরআন ৩:১০৫)।
জাতির বর্তমান দোদুল্যমান অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে আমাদের জাতিসত্তা বিকশিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত পথে জীবন গঠন ও একটি মানবিক সমাজ গঠনে আমাদের সংবিধান ও ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেই আমরা আবারো এক শক্তিশালী ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে পারি, যা যে কোন অশুভ শক্তির মোকাবিলায় সক্ষম।
লেখক : আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী।