
চট্টগ্রামের রাউজানে চাঞ্চল্যকর ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম খুনের নেপথ্যে ছিলো চাঁদাবাজি। চাঁদার টাকা না পেয়েই জুমার নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে যাওয়ার পথে তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই খুনের ঘটনায় আরাফাত মামুন ও বিপ্লব বড়ুয়া নামে দুজনকে গ্রেফতারের পর আলোচিত এই হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটন হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। গ্রেফতার দুইজনের কাছ থেকে পাঁচ রাউন্ড গুলি ভর্তি রিভলবার, একটি রামদা, একটি দেশি এলজি ও দুইটি কার্তুজ উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতার দুই জন যুবদলের কর্মী এবং চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকারের অনুসারি হিসাবে এলাকায় পরিচিত বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সনতু বলেন, হত্যাকা-স্থল এবং আশপাশের সিসি ক্যামেরার ভিডিও এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছেন, মামুনই হত্যাকা-ের হোতা এবং খুনে অংশ নিয়েছিলেন। তিনিই ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করেছিলেন। পুলিশ সুপার বলেন, মামুন রাউজানের পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের গরীব উল্লাহ পাড়ায় তার মামার বাড়িতে সহযোগী বিপ্লবকে নিয়ে পালিয়ে ছিলেন। তাকে গ্রেফতারে পুলিশের অভিযানের সময় তিনি পুলিশকে গুলি করার চেষ্টা করেন এবং ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে পালাতে চান।
বিগত ২৪ জানুয়ারি রাউজানের নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নিরামিষ পাড়ায় খুন হন ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম (৫৫)। তার বাড়ি ওই এলাকার আসত আলী মাতুব্বর পাড়ায়। তবে তিনি থাকতেন চট্টগ্রাম নগরীতে। প্রতি শুক্রবার গ্রামে যেতেন জুমার নামাজ আদায় করতে। চট্টগ্রাম নগরীর আসাদগঞ্জে শুঁটকি ব্যবসা করতেন জাহাঙ্গীর আলম। পাশাপাশি তিনি নোয়াপাড়া এলাকায় একটি কমিউনিটি সেন্টারেরও মালিক।
ওইদিন সেই কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপকের মোটর সাইকেলে করে গ্রামের বাড়ির এলাকায় জামে মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। মসজিদের কাছে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা অস্ত্রধারীরা তাদের ওপর হামলা চালায়। মোটর সাইকেল থেকে পড়ে যাওয়ার পর জাহাঙ্গীরকে গুলি করা হয়। এ ঘটনায় তার সাথে থাকা ম্যানেজার গুলিবিদ্ধ হন। স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক জাহাঙ্গীরকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই খুনের ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়। ভিডিওতে খুনিদের দেখা গেলেও মুখোশ পরা থাকায় তাদের সনাক্ত করতে সময় লাগে। হত্যাকা-ের প্রায় দেড় মাস পর বুধবার খুনি চক্রের দুইজন গ্রেফতার হওয়ায় খুনের রহস্য উদঘাটন হয়।
পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা ব্যবসায়ীর পরিবারের সাথে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছে, বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু কত টাকা সেটা তারা বলেনি। হত্যাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে তিনি বলেন, অপরাধীদের কোনো দল নেই। কিন্তু প্রত্যেক অপরাধী রাজনৈতিক আশ্রয় চায়। সে হিসেবে তারা আশ্রয় নেয়।
গ্রেফতার আরাফাত মামুন (৪৮) ও বিপ্লব বড়ুয়া (৩৫) উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের বাসিন্দা। স্থানীয়রা জানান, আরাফাত মামুন বিএনপি নেতা গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারী যুবদলের নেতা হিসেবে এলাকায় পরিচয় দেন। গোলাম আকবর খোন্দকারের ছবি দিয়ে এলাকার বিভিন্ন সড়কে তোরণ নির্মাণ ও পোস্টার ছাপিয়ে প্রচারও চালিয়ে আসছেন তিনি। তবে যুবদলে তার কোনো পদ-পদবি নেই বলে সংগঠন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিপ্লব বড়ুয়াও যুবদলের রাজনীতিতে সক্রিয়। তিনি আরাফাত মামুনের অন্যতম সহযোগী হিসেবে এলাকায় পরিচিত।
পুলিশ জানায়, আরাফাত মামুনের বিরুদ্ধে এলাকায় চাঁদাবাজি, দলের প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীদের ওপর গুলি-হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত ৭টি মামলা রয়েছে। এর আগে তাকে ধরতে যৌথ বাহিনী একাধিকবার অভিযানও পরিচালনা করেছে। রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। মামলায় খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে চট্টগ্রাম নগরী থেকে দুই জনকে তখন গ্রেফতার করা হয়েছিল। সবমিলিয়ে মোট চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান ওসি। এ মামলায় মামুন ও তার সহযোগীকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় দুজনের বিরুদ্ধে পৃথকভাবে মামলা হয়েছে।
ওসি বলেন, এটি ছিল একটি ক্লু-লেস হত্যাকা-। খুনিদের সনাক্ত করতে ভিডিও ফুটেজ ছাড়া তেমন কোন সূত্র ছিলো না। আবার হত্যকা-ে অংশ নেয়াদের মুখেও ছিলো মুখোশ। তবে ওই ফুটেজ বিশ্লেষণ এবং নানা গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে খুনিদের সনাক্ত করা গেছে। এই খুনে জড়িত সবাই চিহ্নিত হয়েছে। আগে যে দুইজন গ্রেফতার হয়েছে তারাও ঘটনায় জড়িত। আশা করি বাকিরাও ধরা পড়বে।