Status

কারাগার থেকে হৃদয়ের মণিকোঠায় তারেক রহমান

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন করে নাম লেখালো বাংলাদেশ। গণঅভ্যুত্থানের মুখে কেবল একটি সরকারের পতনই নয়, পলায়নেরও সাক্ষী হলো বিশ্ববাসী। কেননা, একসঙ্গে একটি সরকারের সকল মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জাতীয় মসজিদের ইমাম পর্যন্ত পালিয়ে যাওয়ার এই রেকর্ড এর আগে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেনি।

হাসিনার পতনের এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি জুলাই-আগস্টে কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেপথ্যে থেকে ছাত্র-জনতাকে উজ্জীবিত করেন। আওয়ামী সরকারের দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য যুবসমাজকে ভিডিও বার্তায় সাহস জোগান। তাঁর প্রত্যয়দীপ্ত বক্তব্য স্বৈরাচারের স্বরূপ উন্মোচনে ভূমিকা রাখে, ফলে দ্রুত ঐক্যবদ্ধ হয় দেশবাসী। দেশ-বিদেশে গণঅভ্যুত্থানের বিস্তার ঘটে, যা বিশ্বকে নাড়িয়ে বিপ্লবের সারথিদের বিজয় এনে দেয়। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও নেতৃত্বের দৃঢ়তা এখন দেশে-বিদেশে আলোচনার বিষয়।

তারেক রহমান, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যার অভিষেক ঘটে নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময়। সে সময় ওই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আন্দোলনের অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মা খালেদা জিয়ার যোগসূত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তারেক রহমান। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার গঠনের পর থেকে তারেক রহমানের নেতৃত্বগুণের প্রকাশ পেতে থাকে। যদিও কৈশরে বাবা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমন এবং পরে মা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাষ্ট্র পরিচালনা ও নেতৃত্বগুণে প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক রহমানের এই বিকাশমান অবস্থানকে ধীরে ধীরে ভয় পেতে থাকে দেশবিরোধী শক্তিগুলো। কেননা ওই শক্তিগুলোর প্রধান ভয় ছিলো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাজনীতি। জিয়া পরিবারের ক্রমবিকাশমান রাজনৈতিক ধারা তাদের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, গণতান্ত্রিক চেতনা ও আধিপত্যবাদবিরোধী বলিষ্ঠ অবস্থান তাদের অস্তিত্ব সংকটের সৃষ্টি করে। আধিপত্যবাদী শক্তিগুলোর অব্যাহত ষড়যন্ত্রের মুখে ২০০৬ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে সংঘটিত হয় রাজনৈতিক সংঘাত। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে ওয়ানইলেভেন সরকারের উদ্ভব ঘটে। মূলত: দেশপ্রেমিক জিয়া পরিবারকে দেশের রাজনীতি থেকে উৎখাত করার চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তখনই।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে বন্দি করা হয়, যা ছিল সামগ্রিকভাবে এদেশের ১৮ কোটি মানুষের মুক্তির যে স্বপ্ন রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, সেই স্বপ্নকে সেদিন বন্দি করা। পরবর্তীতে তার নামে ১৩টি মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করার পাশাপাশি ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ডিটেনশনও দেয়া হয়। তাকে ছয় দফায় ১৩ দিনের রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনও করা হয়। তার ওপর দেশ ও রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার চাপ প্রয়োগ করা হয়।

তবে দেশ ও দেশের জনগণের কথা ভেবে কুশীলবদের কোনো প্রস্তাবেই রাজি হননি তিনি। ২০০৭ সালের ২৮ নভেম্বর আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারকের অনুমতি নিয়ে তারেক রহমান তার উপর করা অমানবিক নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরেন। সরকারের হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন ও যথোপযুক্ত সময়ে চিকিৎসা না হওয়ায় তারেক রহমানের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলে ২০০৮ সালের ৩১ জানুয়ারি তাকে পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেলে ভর্তি করা হয়। এরপর আদালতের চিকিৎসকদের দেয়া মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়, তারেক রহমানের স্পেশালাইজড অর্থোপেডিক ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন। নির্যাতনে তার মেরুদ-ের ৬ ও ৭ নং হাড় ভেঙে গেছে। কয়েকটি হাড় বেঁকে গিয়েছে। মেরুদ-ের ৩৩টি হাড়ের দূরত্ব কমে গিয়েছে। চোখে ও হৃদযন্ত্রে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। পরে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে পর্যায়ক্রমে তিনটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। মেডিকেল বোর্ডগুলোর পরামর্শ অনুযায়ী উন্নত চিকিৎসার জন্য তারেক রহমানকে বিদেশের অর্থোপেডিক, ফিজিওথেরাপি, কার্ডিওলজি ও রেডিওগ্রাফির সুবিধা সংবলিত যে কোনো হাসপাতালে অতি দ্রুত ভর্তি করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

এরপর তার স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হতে থাকলে তার নিঃশর্ত মুক্তি লাভ ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে রাজপথে শুরু হয় আন্দোলন। এতে সরকারের টনক নড়ে এবং সরকার তারেক রহমানকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিতে সম্মত হয়। কিন্তু আত্মপ্রত্যয়ী ও নির্ভীক তারেক রহমান নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে অনড় থাকেন এবং এক পর্যায়ে উচ্চ আদালত থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জামিনে মুক্তি লাভ করেন। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পান।

সেই থেকে তিনি লন্ডনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তবে কঠিন সময়েও তিনি দেশ ও দল থেকে বিচ্ছিন্ন হননি ক্ষণিকের জন্যও। হাজার মাইল দূর থেকেও তিনি নিয়মিত সাংগঠনিক কর্মকা-ে সক্রিয় রয়েছেন। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে তিনি সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলেন। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতাকর্মীদের একসূত্রে গেঁথে তিনি অভূতপূর্ব সাফল্য দেখান। তার দিক নির্দেশনায় হাসিনাবিরোধী আন্দোলন এদেশের গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। জনগণ বুঝতে পারে শেখ হাসিনা একজন স্বৈরশাসক। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, ভোটাধিকার-গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার-মানবিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে হলে খুনি হাসিনাকে উৎখাতের বিকল্প নাই, এই ধারণাটি মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে যায়। চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান জনতার সেই সচেতন রাজনৈতিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র, সাধারণ কর্মী থেকে নেতা- এই যে শ্রেণিভিত্তিক রাজনৈতিক দর্শনের উন্মেষ সে তো শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানেরই রাজনৈতিক দর্শন, যা কি না তারই উত্তরাধিকার তারেক রহমান প্রবাহিত করতে দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন।

ফ্যাসিবাদের কবলে পড়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি যখন তার পথ হারিয়ে ফেলে তখনই এগিয়ে আসেন শহীদ জিয়ার গর্বিত উত্তরাধিকার তারেক রহমান। দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচাতে তিনি ঘোষণা করেন রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা। গণতন্ত্রের পুনঃস্থাপন, ক্ষমতার ভারসাম্য ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা, মানবাধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, নারী ও যুব উন্নয়ন, পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নসহ শিক্ষাখাতের বৈপ্লবিক পরিবর্তনসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সবগুলো বিষয় এই ৩১ দফার অন্তর্ভুক্ত। তার এই রাজনৈতিক দর্শন শুধুমাত্র সরকারের জন্য নয়, পুরো জাতির জন্য একটি স্বপ্নের প্রস্তাবনা, যা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী, স্বচ্ছ এবং সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে সক্ষম হবে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারের যে আকাক্সক্ষা ও দাবি পরিলক্ষিত হচ্ছে সেটি মূলত তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শনেরই প্রতিবিম্ব।

শিরোনামে ফিরতে চাই এবার। তারেক রহমানকে যখন কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় তখন তিনি ছিলেন একজন উদীয়মান রাজনীতিক। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের একজন সিপাহসালার। এরপর কেটে গেছে আরো প্রায় দুই দশক। এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রের বিকাশ-বিচ্যুতি দেখেছেন। রাজনীতির মাঠে খেলেছেন প্রতিপক্ষের সঙ্গে। দলকে সুসংগঠিত করে স্বৈরাচার হাসিনার বিরুদ্ধে করেছেন লাগাতার লড়াই-সংগ্রাম। তার নেতৃত্বে দল হয়েছে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় শক্তিশালী। সবশেষ চব্বিশের হাসিনা পতন আন্দোলনে তিনি সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মাঠে। জনগণের মৌল-মানবিক অধিকার নিশ্চিত করতে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে তার দলের অসংখ্য নেতাকর্মী। এসব কারণে রাজনীতিক তারেক রহমান এখন আর কোনো নির্দিষ্ট দল-মতের মানুষের নেতা নন। তিনি এদেশের মুক্তিকামী জনতার প্রিয় নেতা।

২০০৭ সালের আজকের এইদিনে তাকে রাজনীতি থেকে সরানোর খায়েশে যে দেশবিরোধী শক্তিটি ষড়যন্ত্র করে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিলো তারা আজ পরাজিত হয়েছে। জনরোষের কবলে পড়া ওই গোষ্ঠীর অনেকেরই ঠাঁই হয়েছে এখন কারাগারে। আর বিপ্লব-দ্রোহের সেই দিনগুলোতে সঠিক নেতৃত্ব দেওয়া তারেক রহমান স্থান পেয়েছেন এদেশের কোটি কোটি মানুষের মনের মনিকোঠায়। দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের সাধারণ মানুষ তাকে ভালোবাসে। কেননা তিনি মুক্তিকামী মানুষের নেতা, আজ এবং আগামীর।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Source link

Leave a Reply

Back to top button