এবার কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে

এবার কৃষক বাঁচাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া জরুরি। যখনই কৃষকের কোনো পণ্য বাম্পার ফলন হয়, তখনই তার দরপতন ঘটে। এমন অবস্থা হয় যে, কৃষক তার সেই উৎপাদিত পণ্য বাজারে ফেলে রেখে চলে যান। আবার কখনও উৎপাদিত ফসল খেতেই পরে থাকে। কারণ দরপতন এতোটাই হয় যে সেই ফসল জমি থেকে তোলার খরচটুকুও ওঠেনা। এসব খবর সংবাদপত্র আর টেলিভিশনে বড় কভারেজ পায়। কিন্তু কৃষকের ভাগ্য বদলায় না। গত দুই সপ্তাহ ধরে আমরা দেখলাম কৃষক তার উৎপাদিত আলু রাস্তায় ফেলে সেখানে গড়াগড়ি করে কেঁদে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করছে। আবার কয়েক শত কেজি টমেটো রাস্তায় ফেলে দিয়ে বিক্ষোভ করছে। প্রশ্ন হচ্ছে এসবে রাষ্ট্রের কি কোনো দায় নেই? কোনো প্রতিকার করার নেই?
গেল মৌসুমে দীর্ঘতম খরা, তারপর বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে শাকসবজির উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল মূল্য। পরে কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আশানুরূপ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। এখন সবজির ভরা মৌসুম। বাজারে শীতের সবজির বিপুল সমারোহ। হরেক রকম সবজির বৈচিত্র্যময় পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। সরবরাহ বাড়ছে প্রতিদিন। ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে সবজির দাম। এখন সব ধরনের সবজির দামই ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে এসেছে। বর্তমানে একটি ফুলকপির দাম ১০- ১৫ টাকা। শিম ১৫-২০ টাকা কেজি। এক কেজি মুলা বিক্রি হচ্ছে ১০-১৫ টাকায়। একটি লাউয়ের দাম ২০-৩০ টাকা। টমেটোর কেজি নেমে এসেছে ২০ টাকায় এবং কাঁচামরিচের কেজি ৪০ টাকায়। অথচ এক মাস আগে এগুলোর দাম ছিল দ্বিগুণেরও বেশি।
এখন দরপতন ঘটেছে সবজির। খামারপ্রান্তে এর দাম বাজারদরের অর্ধেকেরও কম। কৃষকদের অভিযোগ, সবজি বিক্রি করে উৎপাদন খরচও উঠে আসছে না। এ মূল্যবৃদ্ধি ও দরপতনের চালচিত্র হরহামেশাই আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সকলের জানা থাকা দরকার। দেখতে হবে বিভিন্ন সবজির উৎপাদন খরচ কত? কত এর গড় বিক্রয়মূল্য? আর তাতে কৃষকের লাভ কত? তাতে মৌসুমি মূল্যবৃদ্ধি ও দরপতনে ধৈর্যশীল হতে পারবেন আমাদের কৃষক ও ভোক্তারা। বিভিন্ন সবজির দামের ন্যায্যতা তারা অনুভব করতে পারবেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের উদ্যোগে সম্প্রতি বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন খরচ, এদের খামারপ্রান্তের বিক্রয়মূল্য, লাভ ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা সম্পর্কে গবেষণা হয়েছে। এ গবেষণার একটি প্রধান অংশীদার প্রতিষ্ঠান ছিল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। ওই ইনস্টিটিউটের কৃষি অর্থনীতি বিভাগ সমীক্ষা পরিচালনা করছে সবজির উৎপাদন খরচ ও এর লাভ নিয়ে। তারা যে তথ্য উপস্থাপন করেছে, তাতে দেখা যায় সবজির উৎপাদন লাভজনক। কিন্তু খামারপ্রান্তে এর লাভ কম। কারণ এর ওপর যানবাহন ও বাজারজাত খরচ, মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফা এবং পচনশীলতার আর্থিক ক্ষতি যোগ করে নির্ধারণ করা হয় খুচরা বিক্রয়মূল্য। সবজি একটি পচনশীল পণ্য। এর পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ। সে কারণে খুচরা পর্যায়ে সবজির দাম খামারপ্রান্ত থেকে বেশি।
অবস্থাটা এমন যে কৃষককে যতো ঠকানো যায়,ততই লাভ। এই অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কৃষক যেনো তাঁর ফসল মাঠেই ফেলে না রাখে। বাজারে এনে দাম না পেয়ে ফেলে চলে যায়। সড়কে ফেলে না কাঁদে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। এর দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রকে দঁড়াতে হবে কৃষকের পাশে।
তিন বছর ধরে পেঁয়াজের উচ্চমূল্যে ভোক্তারা নাকাল। এর উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি প্রায় ২২ টাকা। খামারপ্রান্তে এর গড় মূল্য ৩০ টাকা। লাভ প্রায় ৮ টাকা প্রতি কেজি। খুচরা পর্যায়ে এর দাম হতে পারে ২৫-৩০ শতাংশ অপচয়সহ সর্বোচ্চ ৫০-৫৫ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হলেও এর গড়মূল্য দাঁড়ায় ৫০-৫৫ টাকা কেজি। সেক্ষেত্রে পেঁয়াজের দামে ধারাবাহিক উল্লম্ফন এবং পরপর দুই বছর ডাবল সেঞ্চুরি ও সেঞ্চুরি হাঁকানোর বিষয়টি উদ্বেগজনক।
দুই বছর আগে এবং এ বছর আলুর উচ্চমূল্যের বিষয়টিও এখানে উল্লেখযোগ্য। উৎপাদন খরচের ভিত্তিতে এবং সংরক্ষণ ও বিপণন খরচ যোগ করে আলুর সর্বোচ্চ মূল্য হতে পারত ৩৫-৪০ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আলু আমদানি করা হলেও এর গড়মূল্য দাঁড়ায় ৩৫-৪০ টাকা। অথচ এবারের নিষ্ফল মৌসুমে ভোক্তাদের মূল্য দিতে হয়েছে প্রতি কেজি ৭০-৮০ টাকা। এটি ব্যবস্থাপনা সমস্যা। এতে বড় ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে। এখানে সিন্ডিকেট ক্রিয়াশীল।
এই সিন্ডিকেটের অতি মুনাফা আদায়ের কারসাজিকে অকার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ ছিল অপর্যাপ্ত। ফলে এ সংকট প্রলম্বিত হয়েছে। তাতে ভোক্তারা ঠকেছে। এখন আবার আলু-পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে খামারপ্রান্তে মূল্য কমে গেছে। তাতে উৎপাদক কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি ও বাজারে সরবরাহ সংকটের কারণে এ দুটো পণ্যের দাম অনেক সময় হয়ে পড়ে আকাশচুম্বী। খুচরা মূল্যের সঙ্গে যৌক্তিক মূল্যের ব্যবধান হয় অনেক বেশি।
উৎপাদন মৌসুমে পণ্য সরবরাহ বেড়ে গেলে যৌক্তিক মূল্যের চেয়েও কমে যায় খুচরা মূল্য। মৌসুমে যখন বাজারে দাম চড়া থাকে তখন যৌক্তিক মূল্যের কথা অনেকে বলে থাকেন। কিন্তু যখন বাজারে দাম কম থাকে তখন যৌক্তিক মূল্যের কথা বলতে তেমন শোনা যায় না। বর্তমানে বাজারে সবজির দাম খুবই নেমে গেছে। ক্ষেত্র বিশেষে তা যৌক্তিক মূল্যের অনেক কম। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক।
চলতি শীতকাল ইতিহাস হয়ে থাকবে কৃষকের লোকসানের বছর হিসেবে। পেঁয়াজ, আলু, বেগুন, ফুলকপিসহ সব ধরনের পণ্য বিপণনে কৃষকদের মাথায় হাত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূল্য ধসে বিক্ষুব্ধ হয়ে ক্ষেতের মুলা,টমেটো,কপি কেটে ক্ষেতেই মিশিয়ে দিতে দেখা যাচ্ছে গ্রামের কৃষকদের। শুধু বাংলাদেশে নয়, উৎপাদন মৌসুমে ফসলের মূল্য হ্রাস পায় পৃথিবীর অনেক দেশেই। কিন্তু বাংলাদেশের মতো এত বেশি তলানিতে নামে না কোথাও। এত তীব্র অনুভূত হয় না কৃষকের বিলাপ।
কৃষক বলছেন,‘এখন নিজের প্রয়োজনে যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকু চাষ করব। আর বাণিজ্যিক চাষ করব না।’ কতোটা হতাশায় তাঁরা এমনটা বলছেন। এক সময় শীতকালীন মৌসুমেই সবজির উৎপাদন হতো বেশি। গ্রীষ্মকালে এর আবাদ ছিল কম। এখন দুটো মৌসুমেই বেড়েছে সবজির আবাদ। গ্রীষ্মকালীন টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁয়াজ সম্পর্কে আমাদের দেশে ৩০ বছর আগেও তেমন বেশি ধারণা ছিল না। এখন তা বাস্তবে সম্ভব হচ্ছে। এটি কৃষি গবেষণার অবদান। শীতকালে এখন মোট উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ সবজির উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। বাকি ৪০ শতাংশ সবজির উৎপাদন হচ্ছে গ্রীষ্মকালে।
বাংলাদেশ বর্তমানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সবজি রফতানি করছে বিদেশে। বছরের পর বছর এর পরিমাণ ও আয় বাড়ছে। ১৯৯৩-৯৪ সালে সবজি রফতানির পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৪২২ টন। আয় হয়েছিল ৯ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর ১৫ বছর পর ২০০৮-০৯ সালে সবজি রফতানি হয়েছে ২২ হাজার ৭৯১ টন। আয় হয়েছে ৪৪ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে রফতানি করা হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার ৫৪৫ টন সবজি। তাতে আয় হয়েছে প্রায় ১১৮ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রফতানির পরিমাণ কিছুটা কমে আয় হয়েছে ১১২ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে পৃথিবীর ৩৫টি দেশে বর্তমানে বাংলাদেশের ফল ও সবজি রফতানি হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হলো যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইতালি ও অন্য ২৮টি দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় শাকসবজির উৎপাদন ব্যয়বহুল। সে তুলনায় বাংলাদেশ থেকে সবজি আমদানি সুবিধাজনক। এক্ষেত্রে বিদেশি বাজারে বাংলাদেশি সবজি রফতানি সম্প্রসারণের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। তবে এর জন্য বিদেশি বাজার চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে মানসম্মত সবজির নিরন্তর সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। সে লক্ষ্যে দরকার ভালো মানের সবজি উৎপাদন। চাই সংগ্রহ উত্তর যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ। এছাড়া বিদেশে সবজি পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত বিমান ও কার্গো স্পেস নিশ্চিতকরণের সঙ্গে এর ভাড়া হ্রাস করাও সবজি রফতানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশে অর্গানিক সবজি আবাদ হচ্ছে। বিদেশে এগুলোর বেশ কদর আছে। দেশের অভ্যন্তরেও এগুলোর চাহিদা আছে। অতিসম্প্রতি ঢাকায় নিরাপদ সবজি বাজারজাতের জন্য ফারমার্স মার্কেট চালু করা হয়েছে। তাতে অর্গানিক সবজির চাহিদা বাড়ছে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি মিশনগুলো এর বাজারজাতে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। এ লক্ষ্যে বিদেশি বাজার ও পণ্যমূল্য সম্পর্কে আমাদের রফতানিকারকদের নিয়মিত অবহিত রাখা প্রয়োজন।
দেশে কৃষিপণ্য সংরক্ষণের সুব্যবস্থা করতে হবে। বাম্পার উৎপাদন যেনো বিফলে না যায় তার সঠিক ব্যবস্থা করতে হবে। এর কেনো বিকল্প নেই। আমরা দেখছি যে কৃষক মাটি থেকে ফসল উৎপাদন করে ক্রেতাদের সামনে এনে দিচ্ছে তার দিকে কারো দৃষ্টি নেই। তার সমস্যা নিয়ে কেউ ভাবছে না। অবস্থাটা এমন যে কৃষককে যতো ঠকানো যায়,ততই লাভ। এই অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কৃষক যেনো তাঁর ফসল মাঠেই ফেলে না রাখে। বাজারে এনে দাম না পেয়ে ফেলে চলে যায়। সড়কে ফেলে না কাঁদে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। এর দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রকে দঁড়াতে হবে কৃষকের পাশে।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এএসএম