Status

উষ্ণ হচ্ছে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক

বাংলাদেশ-পাকিস্তানের শীতল সম্পর্ক ক্রমেই উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে নানা পরিবর্তনের মতো এ দুটি দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নতুন মোড় নিচ্ছে। দু’দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরীর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চিকিৎসা, শিক্ষা, বাণিজ্য,, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, ভ্রমণ, সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে দুই দেশ দ্বিপাক্ষিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে উঠার নমুনা হিসাবে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে পণ্যবাহী দুটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর এ ধরনের আগমন এটাই প্রথম প্রথম। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক একেবারেই তলানিতে ছিল। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সে সম্পর্ককে নতুন করে গড়ে তোলার তৎপরতা শুরু করে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরই মধ্যে দু’জনের দুবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। তারা দু’দেশের সম্পর্ক নতুন করে এ গিয়ে নেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ যেমন পাকিস্তানের সাথে, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে নতুন করে সম্পর্ক গড়তে অগ্রহী তেমনি পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য, অর্থনীতি, সামরিক, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক ও যোগাযোগ আরও নিবিড় করতে চাইছে। দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান যোযোগ এবং জনগণের সঙ্গে (পিপল টু পিপল) পারস্পরিক মতবিনিময়ের জন্য নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। সাম্প্রতিক এক সফরে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ, লাহোর, মারি, তক্ষশিলায় ঘুরে এবং সেখানকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ও নানা অধিদপ্তরের প্রধান, পাকিস্তানের থিংকট্যাংকসহ বিশিষ্টজনদের সাথে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক সবসময়ই একটা সংবেদনশীল বিষয় ছিল। ১৯৭১ সালের ইতিহাস বিবেচনায় এ নিয়ে আলোচনা, রাজনীতিও অনেক হয়েছে। তবে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে আওয়ামী লীগ আমলে, বিশেষত যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রেক্ষাপটে। তবে জুলাই বিপ্লবের পর দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন করে তৎপরতা শুরু হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অনেক দেশের মতো পাকিস্তানও শুভেচ্ছা জানিয়েছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানের দূতাবাসেরও বেশ তৎপরতা দেখা গেছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার দেখা করেছেন বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে। দেখা করেছেন বিএনপির নেতাদের সাথেও। একই সাথে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ফি বাদ দিয়েছে পাকিস্তান। সরাসরি ফ্লাইট চালু করার বিষয়েও চলছে আলোচনা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে সাবেক কূটনীতিকদের সাথে বৈঠক করে কৌশলগত রোডম্যাপ তৈরি করেছেন বলেও জানা গেছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে আলোচনায় আরও নিবিড় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে আগ্রহ জানানো হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে পোস্ট দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
পাকিস্তানের তথ্য সচিব আমব্রিন জান বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তান সবসময়ই একটা শ্রদ্ধাশীল, ইতিবাচক ও গঠনমূলক অবস্থানের আগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে সমস্যা হয়েছে, কিন্তু যখন সেসব সমস্যা অতিক্রম করার ইচ্ছা এবং সামনে এগিয়ে যেতে সম্পর্কের সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করার ইচ্ছা থাকে, তখন দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থে সামনে এগিয়ে যেতে আমরা সমস্ত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবো। বর্তমান জেনারেশন সেটাই চায়। নতুন প্রজন্ম দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে খুবই পজেটিভ।
সফরকালে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সাথে পাকিস্তানের সংস্কৃতি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী আতাউল্লাহ তারারের সৗজন্য সাক্ষাৎ হয়। সেখানে তিনি অত্যন্ত প্রাণবন্ত আলোচনা করেন। এ সময় তার সাথে মুঠোফোনে বাংলাদেশের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর কথা হয়। তিনি দু’দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক নানা বিষয় আদান প্রদানের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ ছাড়া দু’দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির বিষয়েও তারা আলোচনা করেন। এ সময় পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই দু’দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ আরও বৃদ্ধি পাক। এ জন্য সরাসরি ঢাকা-টু ইসলামাবাদ বিমান চলাচল শুরু বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। খুব শিগগিরই এটি চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে পাকিস্তানের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং থিং ট্যাঙ্কাররাও অত্যন্ত আশাবাদী। তারা মনে করেন জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশে এক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। এই ইতিবাচক চিন্তাধারা দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক বূমিকা পালন করবে বলে তারা মনে করেন। ইসলাবাবাদ রিচার্স ইনস্টিটিউট (আইপিআরআই) এর প্রধান ড. রেজা মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক নতুন মোড় নিচ্ছে। এ সম্পর্ক জোরদার করতে পিপল টু পিপল ( দুদেশের জনগণের মধ্যে) যোগাযোগ বাড়াতে হবে। আইপিআরআই আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় কাশ্মিরের শিক্ষার্থী মরিয়ম তৈয়ব বলেন, বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবে আমরা অনুপ্রাণীত। আমরা চাই বাংলাদেশের সাথে আমাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরী হোক। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানা ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে আদান প্রদান হোক। অতীতের সব তিক্ততা ভুলে আমার নতুন প্রজন্ম দু’দেশের সম্পর্ককে পারস্পরিক সৌহাদ্য ও মর্যদার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে চাই।
পাকিস্তান বাংলাদেশের ঠিক প্রতিবেশী রাষ্ট্র না হলেও বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাণিজ্যিক সম্পর্ক একটা বড় দিক। অবশ্য আওয়ামী লীগ আমলেও বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ ছিল না। বাংলাদেশে চামড়া, টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস খাতে পাকিস্তানিদের বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে পাকিস্তান বাণিজ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের আমদানি তালিকায় রয়েছে তুলা, কাপড়, বিভিন্ন রাসায়নিক, খনিজ ও ধাতব উপাদান, বৈদ্যুতিক সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটজাত পণ্য, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, সিনথেটিক ফাইবার, টেক্সটাইল সামগ্রী, কিছু চিকিৎসায় ব্যবহার্য সামগ্রী, এমন বেশ কিছু জিনিস রপ্তানি হয় পাকিস্তানে।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য বাড়তে থাকে। দেখা যায়, আগস্ট থেকে ডিসেম্বরে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আনুমানিক ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। উভয় দেশ নির্মাণসামগ্রী, খাদ্যপণ্য, ওষুধ এবং তথ্যপ্রযুক্তির মতো ক্ষেত্রগুলোয় বাণিজ্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে। পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে বার্ষিক বাণিজ্য চারগুণ বৃদ্ধি করতে চায়। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য ছাড়িয়ে গেছে ১০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশে পাকিস্তানি বহু পণ্যের ব্যাপক চাহিদা আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বাণিজ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশি পণ্যের বিরাট বাজার আছে পাকিস্তানে। তা থেকে পাকিস্তান সুবিধা পেতে পারে। ভ্রাতৃত্বপূর্ণ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেলে দু’দেশেই এতে লাভবান হবে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, আমাদের কতগুলো ইস্যুও আছে যেগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনা বন্ধ হয়ে ছিল। দেখা যাক সেগুলি কতটুকু কী করা যায়, আমরা দেখবো আগামী দিনগুলিতে যে পাকিস্তানের সাথে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যেখানে পাকিস্তান তাদের স্বার্থ দেখবে, আমরা আমাদের স্বার্থ দেখবো। দু’দেশের মধ্যে সমমর্যাদার ভিত্তিতেই এসম্পর্ক এগিয়ে যাবে।

 

Source link

Leave a Reply

Back to top button