
উপকূলীয় জেলা বরগুনার শ্যামল ছায়ার কোমল পরশ, বঙ্গোপসাগরের শোঁ শোঁ গর্জন, মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক অপরূপ লীলাভূমি, ছায়াঘেরা বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল, চোখ ধাঁধানো চরাঞ্চল, একবিন্দুতে প্রমত্তা তিনটি নদীর বৈচিত্র্যময় মোহনা, বলেশ্বরের তীরে পৃথিবীখ্যাত মায়াবী চিত্রল হরিণের দুরন্তপনা, তালতলীর রাখাইন নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনচিত্র, উপকূলে বসবাসরত সাধারণ মানুষের জীবনযুদ্ধ যে কাউকেই মুগ্ধ করে। বরগুনার এমন বাহারি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার অন্য কোথাও দুর্লভ বলে ধারণা পর্যটকদের। পর্যটন শিল্প বিকাশে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় বরগুনা জেলা। অথচ অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেই স্থবিরতায় আচ্ছন্ন রয়েছে এ খাতটি।
বরগুনায় অসংখ্য স্পট রয়েছে, যেখানে প্রকৃতির এমন নিবিড় সান্নিধ্য পাওয়া যায়। অনেকেই মনে করেন, বঙ্গোপসাগরের তীরের জেলা বরগুনার এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ঘিরে দেশের পর্যটনশিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। বিপুল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করতে শুধু প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ।
বরগুনার তালতলী উপজেলার আশারচর, নিদ্রা সৈকত, শুভসন্ধ্যা, সোনাকাটা, টেংরাগিরি ইকো পার্ক, রাখাইন পল্লী, পাথরঘাটার লালদিয়া, হরিণঘাটা ইকো পার্ক , পদ্মার চর, বিহঙ্গ দ্বীপ, নীলিমা পয়েন্ট, বরগুনা সদরের সুরঞ্জনা ইকো ট্যুরিজম এন্ড রিসোর্ট, টুলুর চর, মাঝের চর, মোহনা পর্যটন কেন্দ্র, গোড়া পদ্মা ও সোনাতলা বনাঞ্চল ঘিরে গড়ে উঠতে পারে দেশের পর্যটনশিল্পের বিরাট সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।
বঙ্গোপসাগরের কোলে গড়ে ওঠা টেংরাগিরি ইকো পার্কে কান পাতলে শোনা যায় সাগরের শো শো গর্জন। সাগর থেকে উঠে আসা বাতাসে ছন্দময় অনুরণন তোলে বনের পত্রগুচ্ছ। তালতলীর ফকিরহাটের টেংরাগিরি একসময় সুন্দরবনের অংশ ছিল। প্রাকৃতিক এই বনকে স্থানীয় লোকজন ‘ফাতরা বন’ হিসেবে চেনে। সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় টেংরাগিরি বনাঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৬৭ সালে।
তালতলী থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত বিস্তৃত এই বনের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। ২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর ৪ হাজার ৪৮ দশমিক ৫৮ হেক্টর জমি নিয়ে গঠিত হয় টেংরাগিরি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য। এই বনাঞ্চলের তিন দিকে বঙ্গোপসাগর, বান্দ্রা, মেরজে আলী, সিলভারতলী, ফেচুয়া, গৌয়মতলা, কেন্দুয়া, সুদির, বগীরদোন। টেংরাগিরি বনাঞ্চলের অভয়ারণ্যে হরিণ, শূকর, চিতাবাঘ, অজগর, কুমির, বানর, শজারুসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। গেওয়া, জাম, ধুন্দল, কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, করমচা, বলই কেওয়া, তাল, কাঁকড়া, হেতাল, তাম্বুলকাটা গাছের সমাহার রয়েছে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে। তালতলীর ২৩টি পল্লীতে বসবাস করছে শ’ বছরের পুরোনো রাখাইন সম্প্রদায়। তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন, প্রাচীন উপাসনালয়, বুদ্ধমূর্তিগুলো পর্যটকদের ভিন্নমাত্রার আনন্দ দেয়। টেংরাগিরি বনের খুব কাছেই আরেক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাকেন্দ্র সোনাকাটা চরাঞ্চল। এর একদিকে টেংরাগিরি বনের সবুজ নৈসর্গ্য আর অন্যদিকে বিশাল সৈকতের বুকে কান পাতলে শোনা যাবে বঙ্গোপসাগরের কুল কুল ধ্বনি। সোনাকাটায় দেখা যাবে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য। বালিহাঁস, গাঙচিল, পানকৌড়িসহ হরেক পাখির কুজনে সব সময় মুখর থাকে আশারচর। তালতলীর অদূরে অবস্থিত আশারচরে রয়েছে শুঁটকির সাম্রাজ্য। রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে দূর সাগরের বুকে মাছ ধরতে নামা ছোট ছোট ডিঙিনৌকার টিপটিপ আলোর মিছিল। দূর থেকে দেখলে মনে হবে ভাসমান কোনো শহর।
মায়াবী হরিণের দল বেঁধে ছুটে চলা, চঞ্চল বানর আর বুনো শূকরের অবাধ বিচরণ, পাখির কলরবে সারাক্ষণ মুখর থাকে হরিণঘাটা বনাঞ্চল। পাথরঘাটা উপজেলায় বঙ্গোপসাগরের মোহনায় পায়রা-বিষখালী-বলেশ্বর তিন নদ-নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত হরিণঘাটা। সৃজিত এই বনে হরিণ, বানর, শূকর, কাঠবিড়ালী, মেছো বাঘ, ডোরা বাঘ, শজারু, উদ, শৃগালসহ অসংখ্য বুনো প্রাণীর বিচরণ। সুন্দরবনের চেয়ে আকৃতিতে বড় প্রজাতির মায়াবী চিত্রল হরিণের বিচরণস্থল হওয়ায় এই বনের নামকরণ হয়েছে হরিণঘাটা। দৃষ্টিনন্দন ঘন বন আর সবুজে ছাওয়া হরিণঘাটা বনের সৌন্দর্যকে আরও আকর্ষণীয় করেছে পাশাপাশি সুবিশাল তিনটি সৈকত লালদিয়া, পদ্মা ও লাঠিমারা। লালদিয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ইকো ট্যুরিজম সুযোগ বৃদ্ধি প্রকল্পের’ আওতায় ৯৫০ মিটার পায়ে হাঁটার কাঠের ব্রিজ স্থাপন করা হয়েছে। রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার বেঞ্চ, ঘাটলা ও ইটের রাস্তা। মিঠাপানির জন্য খনন করা হয়েছে পুকুর।
সোনাতলা, বাবুগঞ্জ, ছোনবুনিয়া, পদ্মা, কুমিরমারা এই এলাকার বিস্তীর্ণ চর ঘিরে গড়ে ওঠা সৃজিত এই বনভূমির আয়তন ৪ হাজার ৬০০ একর। সারি সারি কেওড়া, গেওয়া গাছে ছাওয়া এই বনে শূকর, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, মেছো বাঘসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণী রয়েছে। রয়েছে একটি পিকনিক স্পট, কয়েকটি গোলঘর, একটি ডাকবাংলো, পুকুর।
বরগুনায় দর্শনার্থীদের পছন্দের শীর্ষে সুরঞ্জনা ইকো রিসোর্ট। সম্ভাবনাময় জেলা বরগুনার পযর্টন শিল্পের উন্নয়নে সুরঞ্জনা একটি সৃজনশীল স্থানীয় উদ্যোগ। বর্তমানে স্থানীয় ও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা পরিবার-পরিজন বা প্রিয়জনকে নিয়ে ভিড় করছেন সুরঞ্জনা ইকো রিসোর্টে।
শহরের খুব কাছে প্রকৃতির মাঝে একখণ্ড অবসর কাটানোর স্থান হলো সুরঞ্জনা ইকো টুরিজম অ্যান্ড রিসোর্ট।বরগুনা জেলা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গণের নেতৃবৃন্দের সার্বিক সহযোগিতায় এটি বরগুনার প্রথম ও একমাত্র বেসরকারি পযর্টন কেন্দ্র সুরঞ্জনা ইকো টুরিজম অ্যান্ড রিসোর্ট। এখানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা উপভোগ করছেন বিস্তির্ণ জলমোহনায় ম্যানগ্রোভ বনভূমি যার মধ্যে আছে গোল, হোগল আর নলখাগড়ার বন। হেঁটে হেঁটে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি রয়েছে শিশুদের জন্য নানান উপকরণ। এখানে আছে তৈরিকৃত কুমির, কাকরা, বাঘ, হরিণ, জিরাফ ও বক। এখানকার বন-দীঘিতে ফুটে থাকা হরেক রঙের পদ্মর মাঝে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোয় মুগ্ধ হন দর্শনার্থীরা।
এখানকার স্নিগ্ধ সরোবরে ঘুঘুদের জলকেলি, পানকৌড়ির ডুবসাতার, ডাহুকের ডাক এমন সব কিছুতেই দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া, গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী এবং বরগুনা সদর, আমতলী, তালতলী ও পাথরঘাটা উপজেলাকে ঘিরে বিশেষ পর্যটনশিল্প গড়ে তুলতে পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। ‘পায়রা বন্দরনগরী ও কুয়াকাটা উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ-পর্যটনভিত্তিক সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন নামে এই প্রকল্পটি ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে পরিকল্পনা কমিশন এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়।
এ প্রকল্পের আওতায় বরগুনার পাথরঘাটা, আমতলী, তালতলী উপজেলা এবং পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরতুফানী, জাহাজমারা প্রভৃতি পর্যটন আকর্ষণ এলাকাকে সমন্বিত সমুদ্রভিত্তিক পর্যটন পরিকল্পনার আওতায় নেওয়া হয়েছে।
বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় বরগুনার পর্যটনকেন্দ্রগুলো কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। ইতোমধ্যেই অবকাঠামো সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়াও বেসরকারি উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য পর্যটন শিল্পের সাথে সম্পৃক্তদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।