ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ফাঁকে-তালে বেঁচে যায় নিয়োগ বাণিজ্যের ‘মাস্টারমাইন্ড’ মাহবুব!

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) নিয়োগ বাণিজ্যের ‘মাস্টারমাইন্ড’ খ্যাত আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু পরিষদের বর্তমান সদস্য সচিব প্রফেসর ড. মাহবুবর রহমান। যিনি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ও সাবেক প্রক্টর। একইসঙ্গে প্রগতিশীল শিক্ষকদের সংগঠন শাপলা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে মূলত প্রক্টর থাকাকালীন তৎকালীন ভিসি ড. আসকারীর আস্থাভাজন হওয়ায় সেসময় তার মাধ্যমেই নিয়োগ বাণিজ্য হতো বলে অভিযোগ রয়েছে । তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ডেকে হুমকি দেওয়া, ডিবিকে বিতর্কিত করা, গাড়ি ব্যবহারে অনিয়ম ও নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে তার অডিও ফাঁস হয়। এসব ঘটনার অর্ধযুগ পেরিয়ে গেলেও তার বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। সে সময়ের ভিসি প্রফেসর ড. হারুন অর রশিদ আসকারীর আস্থাভাজন হওয়ায় তিনি বারবার পার পেয়ে গেছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
এদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তিনি প্রকাশ্যে বিরোধীতা করেন। গত বছরের ৪ আগস্ট শাপলা ফোরামের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল হয় শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে। এসময় জুলাই আন্দোলনকারীদের নৈরাজ্যকারী আখ্যা দেন তারা। স্বৈরাচারী সরকার শেখ হাসিনার পতনের ছয় মাস পেরোলেও তার বিষয়ে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নেয়নি বর্তমান প্রশাসন। এ নিয়ে সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রফেসর ড. হারুন উর রশিদ আসকারী ভিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর একের পর এক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে । ভিসির মদদপুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের একটি চক্র ড. আসকারীর আমলে বছর পর বছর ধরে নানা অপকর্ম চালিয়েছিল বলে অভিযোগ খোদ আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের। আর এ চক্রের মূল হোতা হিসেবে ড. মাহবুবকে চিহ্নিত করে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনও করেছেন আওয়ামীপন্থীরা। বিশেষ করে শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্য, মেগা প্রকল্পের আড়ালে দুর্নীতি আর বিধি লঙ্ঘন করে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মীসহ প্রায় দুই শতাধিক লোককে ডে-লেবার হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ছিল সে সময়ে বহুল আলোচিত। এছাড়া তার নিয়োগ বাণিজ্য সংক্রান্ত একাধিক ফোনালাপের অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ড. মাহবুবের নিয়োগ বাণিজ্য সংক্রান্ত একটি অডিও প্রকাশ হয়। ওই অডিওতে ‘মূল হোতা’ হিসেবে সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাহবুবের নাম উঠে আসে। এছাড়া আব্দুল হালিম নামের এক নিয়োগপ্রার্থীকে ভাইভার পর ডেকে ব্রেইনওয়াশ করতে বলেন ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. রুহুল আমিনকে। এই অডিওতে ড. মাহবুবকে বলতে শোনা যায়, ‘ও (হালিম) চালাকি করতেছে, এখন যদি ওর ব্রেইনওয়াশ না করে দেই তাহলে বিরাট সর্বনাশ হয়ে যাবে।’ সেসময়ে অডিওটি নিজের বলে স্বীকার করে নেয় ড. মাহবুব। তবে ওই সময়ও এসব ঘটনায় মাফ পেয়ে যান তিনি। এদিকে ২০২০ সালে শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের ঘটনা তদন্তে ড. মাহবুবসহ তিন শিক্ষক ও এক নিয়োগ প্রত্যাশীকে কার্যালয়ে তলব করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে এরপর সেই বিষয়ের কোন সুরাহা হয়নি। ২০১৭ সালের সেপ্টম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর থাকাকালীন ড. মাহবুবর রহমানের বিরুদ্ধে নিয়োগবাণিজ্য ও অর্থ-আত্মসাতের অভিযোগ আসলে তৎকালীন প্রশাসন এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। পরে এসব অভিযোগের বিচার দাবিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ।
এদিকে ২০১৯ সালে নিয়োগ বাণিজ্য সংক্রান্ত কয়েকটি অডিও ফাঁস হয়। এতে সাবেক প্রক্টর ড. মাহবুবসহ ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ড. রুহল আমিন ও ইইই বিভাগের ড. এস এম আব্দুর রহিমের নাম উঠে আসে। শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে আরিফ খান নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর কাছে ২৮ লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরে দাবি করা অর্থের পরিমাণ কমিয়ে ১৮ লাখ টাকা করা হয়। ফাঁস হওয়া ফোনালাপ থেকে এমনটিই জানা যায়। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় আরিফ হাসান খান নামের ওই প্রার্থীকে তার সব যোগ্যতা থাকার পরও পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়নি। এই ফোনালাপ ফাঁস হলে তদন্ত কমিটি গঠন করে তৎকালীন প্রশাসন। সেই তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সরওয়ার মুর্শেদ রতন। পরে তিনি সাবেক প্রক্টরসহ অন্যদের চাপে পদত্যাগ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে থেমে যায় তদন্তকাজ। পরে আরিফ হাসান খান বিচার চেয়ে তিন পৃষ্ঠার একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছিল ভিসির কাছে।
২০১৭ সালে ড. মাহবুবের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগ উঠে। নীতিমালায় গাড়ি বরাদ্দ না থাকলেও তার ব্যবহৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ছয় মাসে (২০১৭ সালের জানুয়ারি-জুন) ১১ হাজার ২২৩ কিলোমিটার চলাচল করেছিল। এতে ব্যয় হয়েছিল ১ লাখ ২৩ হাজার ৬০৫ টাকা। এ নিয়ে ওই সময় নানা সমালোচনার সৃষ্টি হলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অভিযুক্ত এই শিক্ষককের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য করেছিলেন তৎকালীন ভিসি ড. হারুন উর রশিদ আসকারী।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সন্তানদের জন্য ২০০৫ সাল থেকে কেন্দ্রীয় মসজিদে নুরানী মক্তব চালু ছিলো। কিন্তু ২০১৭ সালে গোয়েন্দা তথ্যের দোহাই দিয়ে মক্তবটিকে জঙ্গী কারখানা আখ্যা দিয়ে বন্ধ করে দেন তৎকালীন প্রক্টর ড. মাহবুব ও সাবেক ভিসি ড. আসকারী। মক্তবের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা এসব অভিযোগ করেছেন।
এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে ৫৩৭ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের টেন্ডার ঘিরে ইবির প্রধান প্রকৌশলীকে হুমকির অভিযোগ ওঠে ড. মাহবুব ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিবের বিরুদ্ধে। তারা একটি বড় কাজ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতাকে দেওয়ার জন্য চাপ দেন। এ ঘটনার পর প্রধান প্রকৌশলী আলিমুজ্জামান টুটুল পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন। এ ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হলে ওই প্রকৌশলীর বাসায় গোপনে এসে দেখা করেন সাবেক প্রক্টর মাহবুবুর রহমান। এ বিষয়ে ভিসি তদন্ত টিম গঠন করলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
ভিসি প্রফেসর ড. রাসিদ আসকারী বলেন, নিয়োগ বাণিজ্যের যে সকল অভিযোগ গুলো আনা হয়েছে সেগুলো সত্য নয়। এ বিষয়ে প্রফেসর ড. মাহবুবর রহমানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়!
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, ‘ইউজিসিকে বলেছি সকল দুর্নীতির বিষয়ে হাই পাওয়ার কমিটি করার জন্য। তারা আবেদন করতে বলেছিল। আমি ইতোমধ্যে ইউজিসি বরাবর আবেদনও দিয়েছি।’