ইফতারে ফুঠপাতের দোকানগুলোই নিম্নবিত্তের চাহিদা মেটায়
রমজানের বিকেলে ব্যস্ত হয়ে ওঠে রাস্তার ঢাকার ওলিগলি। শহরের ফুটপাত দিয়ে বসানো হয় ইফতারির নানা রকমের দোকান। হাক ডাক আর সুরগোলে কমতে থাকে দিনের সময়, ঘনিয়ে আসতে থাকে ইফতারের মূহুর্ত। শহরের মানুষের মধ্যে একটা বড় অংশ ইফতার করেন রাস্তার ফুটপাতের দোকানগুলো থেকে। মানুষের বিশাল চাহিদার তুলনায় খাবারের যোগান কম থাকায় সেই ঘাটতি পূরণ করে এসব দোকান। দোকানের নানা রকম ইফতারির দাম সবার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে। তবে খাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তা জনমনে খুব বেশি প্রভাব পড়ছে না ।
বিকেলে চাকরি শেষে হেটে বাসায় যাওয়ার সময় ছোলা ,চপ, আনারস ও শরবত কিনে নিয়ে যাচ্ছেন রায়হান মিয়া। তিনি বলেন, ফুটপাতের এসব দোকান আমাদের নি¤œবিত্ত মানুষের জন্যই ,দামও কম । আমাদের মতো একশ্রেণির মানুষ বাসায় গিয়ে রান্না করা, ইফতারি প্রস্তুত করা এগুলো ঝামেলা মনে হয় । আমরা রাস্তায় কিনে ফেলি ,আজান হয়ে গেলে খাওয়া শুরুর করি ।
ইফতারে খেজুর রাখার চেষ্টা করেন সকল মুসলিম কিন্তু দেশের নি¤œবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের খাবারের টেবিলে ফলের আনাগোনা খুবই কম। বাংলাদেশের সাথে অন্যান্য দেশের ইফতারের কয়েক আইটেমের মিল পাওয়া যায় যেগুলো সব দেশেই সহজলভ্য। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ইফতার বাজার রোজার দুপুর থেকেই চকবাজার শাহী মসজিদ, নাজিরা বাজার, নাজিম উদ্দিন রোডের সামনে ও আশপাশের দোকানিরা ইফতারের বিভিন্ন আইটেম সাজিয়ে বসেন। বিক্রি চলে ইফতারের সময় পেরিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
গতকাল মঙ্গলবার বিকালে তৃতীয় রমজানে পুরান ঢাকার ইফতার বাজারে গিয়ে দেখা যায় সেখানে ইফতার কিনতে ভিড় করেছে হাজারো মানুষ। ভিড়ের কারণ তিল ধারণের জায়গা নেই সেখানে। পুরান ঢাকার বংশালের ফুটপাতে, নাজিরা বাজার রোডের দুইপাশে, হোটেলগুলোতেও ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেছে। বিক্রেতারা কেউ হাঁকডাক দিয়ে ক্রেতাদের ডাকছেন, কেউ খাবার প্যাকেট করছেন। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা এসে ভিড় জমাচ্ছেন ইফতার কিনতে। দুপুর থেকে শুরু হওয়া এই ইফতার বাজারে সময়ের সাথে সাথে ভিড় বাড়তে থাকে। আসরের নামাজের পর থেকে সেখানে পা ফেলার জায়গা থাকে না। ক্রেতারা বলছেন, ইফতারের দাম গত বছরের চেয়ে কিছুটা বেশি। অন্যদিকে বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে সব জিনিসপত্রের দাম বেশি হওয়ায় তাদের দাম বাড়াতে হয়েছে।
নাজিরা বাজারের ইফতার বাজার ঘুরে দেখা যায়, এখানকার ইফতারের অন্যতম আকর্ষণ কাবাব, মাঠা, ফিন্নি ও বিরিয়ানি। এগুলো কিনতেই ক্রেতাদের ভিড় বেশি। মাংস, সুতি কাবাব, ডাবলি, ডিম, মগজসহ নানা রকমের চপ । এছাড়া পুরান ঢাকার অন্যতম বিখ্যাত সুতি কাবাব বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা কেজি দরে। শাহি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা কেজি, ঘুগনি ১৬০ টাকা, চিকেন আচারি ১৩০ টাকা, ডিসেন্টের হালিম ৮০০ টাকা কেজি, বটি কাবাব ১৩০ টাকা, দই বড়া ১৫০-২০০ টাকা, শাহী জিলাপী ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, আস্ত কোয়েল পাখির রোস্ট ৮০ টাকা, কবুতর রোস্ট ৮০ টাকা, বাদামের পরোটা ৮০ টাকা, খাসির লেগ পিস ৮০০ টাকা, মোহাব্বাদের শরবত প্রতি লিটার ২০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। এইসব খাবারের পাশাপাশি বেকারি ও আলাউদ্দীন সুইটমিটের ইফতার আইটেমও সকলের পছন্দের। বংশাল থেকে ইফতার কিনতে এসেছেন জাহিদ । তিনি বলেন, প্রতি বছর রোজায় চকবাজার থেকে ইফতার কিনি। আজকে নাজিরা বাজারে আসছি । এখানকার মাঠা , শাহি হালিম ও বিভিন্ন আইটেমের কাবাবের স্বাদ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। সব কিছুর দাম গতবারের মতোই রয়েছে বলে জানান তিনি। ছেলেকে নিয়ে কামরাঙ্গীরচর থেকে ইফতার কিনতে এসেছেন তোফাজ্জর হোসেন। তার সাথে কথা হলে তিনি জানান, নাজিরা বাজারে এসে ইফতার কিনলে সব কিছু পাওয়া যায়। বাসায় বানানো খাবারই বেশি খাই, তবে মাঝে মাঝে জিলাপি বা হালিমের জন্য আসি ।এখানে প্রচুর ভিড় থাকে, তারপরেও এতে মানুষের পদচারণায় ভালোই লাগে। আমার ছোট্ট ছেলেটাও ভিড় ঠেলে ইফতার কেনাকাটার এই মজাটা উপভোগ করে। ফুটপাতের পাশে চিকেন কাবাব বিক্রি করছিলেন । তিনি জানান, গতবারের চেয়ে এবার সব কিছুর দামই বেড়েছে। তবে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা ও চাহিদার কথা মাথায় রেখে আমরা দাম বাড়াইনি। সব কিছুর দাম আগের মতোই রেখেছি। আমাদের সব বানানোর সাথে সাথেই বিক্রি হয়ে যায় তাই খাবার ঢাকা হয় না। তাছাড়া কাবাব ঢেকে রাখলে কাস্টমার দেখবে না। লাচ্ছি শরবত বিক্রি করা দোকানি বলেন, এখানে আমি গত ১০/১২ বছর ধরে শরবত বিক্রি করি। এর আগে আমার চাচা বিক্রি করতে। ইফতারের বাজার আগে যেমন ছিলে, এখনও তেমনই আছে। স্ত্রী ও এক সন্তানের ছোট পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন হাসিফ আহমেদ। ঘরে ইফতার বানানো খরচ ও ঝামেলা মনে করেন বলে বাহির থেকে কিনে নিয়ে যান বলে জানান। তিনি বলেন, ইফতার বানানোর সব জিনিসপত্রের দাম অনেক। বানাতেও তেল অনেক খরচ হয়। ছোট পরিবার, ঈদের ১০ দিন আগেই ফ্যামিলি গ্রামে চলে যায়। সব মিলিয়ে হিসাব করলে দৈনিক অল্প করে কিনে নিয়ে গেলেই ভালো হয়। ইফতারের জন্য এলাকার দোকানদার ওপর নির্ভর করতে হয় জানিয়ে ব্যাচেলর মনির হোসেন বলেন, আমাদের তো বানানোর লোক নাই। তাই প্রত্যেক দিন মেসের কারও না কারও দায়িত্ব পড়ে ইফতার নিয়ে যাওয়ার। তাই আসা।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আব্দুল জাব্বার বলেন, ইতিমধ্যে আমাদের বেশ কয়েকটি টিম মাঠে কাজ করছে। পুরান ঢাকার চকবাজারসহ অন্যান্য ইফতারের বাজারগুলোতেও আমরা অভিযান পরিচালনা করব। গ্রাহকের জন্য মানসম্মত ও যথামূল্যে খাবার নিশ্চিত করাটাই আমাদের লক্ষ্য। বেশির ভাগ মানুষ বাসায় তৈরি ইফতারকেই প্রাধান্য দেয়। তবে কর্মজীবী মানুষেরা, বিশেষত ব্যাচেলর বা ছোট পরিবারে থাকা ব্যক্তিরা বাজার থেকে ইফতার কিনতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কেউ কেউ বাসার ইফতারের সঙ্গে বাহির থেকে বিশেষ কোনও খাবার নিয়ে যান।