‘আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার অনুপম শিক্ষা’


পবিত্র কুরআনের সুরা আলে-ইমরানের ২৬ নম্বর আয়াত একটি শক্তিশালী ঘোষণা, যা আল্লাহর সর্বময় কর্তৃত্ব ও সীমাহীন ক্ষমতার সুস্পষ্ট বার্তা দেয়। এটি মানুষের সেই প্রচলিত বিশ্বাসকে নাকচ করে, যা মনে করে যে ক্ষমতা কেবলমাত্র মানুষের প্রচেষ্টা, রাজনীতি বা বংশগৌরবের ফল। এই আয়াত শাসকদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে তাদের ক্ষমতা আসলে আল্লাহর দেওয়া একটি আমানত, যা তিনি ইচ্ছা করলে ফিরিয়ে নিতে পারেন।

আয়াতের মূল শিক্ষা

১. ক্ষমতার স্থায়িত্ব নেই—নেতাদের জন্য সতর্কবার্তা

কেউ যদি ক্ষমতার আসনে বসে, তার উচিত বিনয়ী ও দায়িত্বশীল হওয়া। কারণ ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়; এটি একটি পরীক্ষা, যা আল্লাহ মানুষের ওপর অর্পণ করেন এবং প্রয়োজনে তা ফিরিয়ে নেন।

২. নির্যাতিতদের জন্য সান্ত্বনা

অত্যাচারিতরা যেন কখনো হতাশ না হয়, কারণ জুলুম ও অন্যায় চিরকাল টেকে না। ইতিহাস সাক্ষী, প্রতিটি স্বৈরশাসকের পতন একসময় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।

৩. পার্থিব ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করা

আমাদের উচিত দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির পেছনে অন্ধভাবে না ছোটা। প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদা আসে একমাত্র আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে, রাজনৈতিক বা পার্থিব প্রতিষ্ঠা থেকে নয়।

আরও পড়ুন

আল্লাহ যাকে চান সম্মানিত করেন, যাকে চান অপমানিত করেন

ইতিহাস থেকে শিক্ষা:

• নবি ইউসুফ (আ.) – দাস হিসেবে বিক্রি হয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তাকে মিসরের শাসক বানিয়েছিলেন।

• ফেরআউন – বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শাসক ছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তাকে নীলনদে ডুবিয়ে ধ্বংস করেন।

• কুরাইশদের অবজ্ঞা – কুরাইশরা রাসুল (সা.)-কে এতিম বলে অবজ্ঞা করেছিল, কিন্তু আল্লাহ তাকে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিতে পরিণত করেন।

শিক্ষা: সত্যিকারের সম্মান ও মর্যাদা আসে আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে, পার্থিব ক্ষমতা বা সম্পদের মাধ্যমে নয়।

সব কল্যাণ আল্লাহর হাতে

আল্লাহর ওপর আস্থা রাখা:

‘তোমার হাতেই সকল কল্যাণ…’ – এই বাক্যটি বোঝায় যে ভালো-মন্দ সবকিছুই আল্লাহর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কখনো আমরা যা হারাই, তা হয়তো আমাদের জন্য মঙ্গলজনক, যদিও আমরা তা তখনই বুঝতে পারি না।

উদাহরণ:

অনেক সময় একটি চাকরি হারানো বা কোনো সুযোগ হাতছাড়া হওয়া আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হয়। এটি হয়তো অহংকার থেকে রক্ষা করে বা আমাদের আরও ভালো কিছুর দিকে নিয়ে যায়।

শিক্ষা: আমাদের উচিত আল্লাহর পরিকল্পনার ওপর পূর্ণ আস্থা রাখা, কারণ তিনি জানেন কোনটি আমাদের জন্য ভালো।

আল্লাহ সর্বশক্তিমান

‘নিশ্চয়ই, তুমি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।’

এই বাক্যটি ঘোষণা করে যে আল্লাহর ক্ষমতা সীমাহীন। তিনি যেকোনো পরিস্থিতি মুহূর্তেই বদলে দিতে পারেন।

শিক্ষা:

• কোনো শক্তিশালী ব্যক্তি বা শাসক আসলেই শক্তিশালী নয়—সবাই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন।

• আল্লাহর জন্য অসম্ভব কিছু নেই—তিনি যেকোনো সময় পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে পারেন।

আমাদের করণীয়

বিনয়ী থাকা – ক্ষমতা পেলে অহংকারী না হয়ে দায়িত্বশীল হওয়া, কারণ আল্লাহ যখন চান, তখন তা কেড়ে নেন।

জালিমদের ভয় না পাওয়া – অন্যায়কারী যত শক্তিশালী হোক, তার শাসন একদিন শেষ হবেই।

ন্যায়ের পথে সম্মান খোঁজা – প্রকৃত সম্মান আসে ঈমান ও সত্যনিষ্ঠতা থেকে, ক্ষমতা বা বিত্ত থেকে নয়।

আল্লাহর পরিকল্পনার ওপর আস্থা রাখা – জীবনের প্রতিটি সংকটে আল্লাহর ওপর নির্ভর করা।

সাহায্যের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা – সফলতা ও সুরক্ষার জন্য একমাত্র আল্লাহর দ্বারস্থ হওয়া।

চূড়ান্ত উপলব্ধি

এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সকল ক্ষমতা, সম্মান ও নিয়ন্ত্রণ একমাত্র আল্লাহর হাতে। দুনিয়ার প্রতিটি সাম্রাজ্য ও শাসক একসময় বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছাই চিরস্থায়ী। তাই, আমাদের উচিত ন্যায়ের পথে চলা এবং পার্থিব ক্ষমতার পেছনে ছুটে নিজের আত্মা ও নৈতিকতাকে বিসর্জন না দেওয়া।

চালাও সে পথে, যে পথে তোমার প্রিয়জন গেছে চলি

মানুষ এক অনন্ত যাত্রার পথিক। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই দীর্ঘ যাত্রায় আমরা প্রিয়জনদের ভালোবাসায় গড়ে উঠি, তাদের শিক্ষা ও আদর্শে পথ চলতে শিখি। কিন্তু সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না—একদিন আমাদের প্রিয়জনরা চলে যায়, হয়তো চিরতরে। তখন জীবন আমাদের সামনে এক কঠিন প্রশ্ন রেখে যায়—আমরা কি সেই পথেই চলব, যে পথে তারা গেছেন?

ভালোবাসার পথ ধরে

প্রিয়জনেরা আমাদের জীবনে কেবল মানুষ নয় বরং তারা একেকটি বাতিঘর। তাদের জীবনাদর্শ, সংগ্রাম ও স্বপ্ন আমাদের জন্য দিকনির্দেশনা হয়ে ওঠে। যখন আমরা তাদের দেখানো পথে চলি, তখন কেবল তাদের স্মরণ করি না বরং তাদের অসমাপ্ত কাজকেও এগিয়ে নিয়ে যাই।

ইতিহাস সাক্ষী, বহু মহাপুরুষ তাদের পূর্বসূরিদের দেখানো পথে হেঁটে সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছেন। যেমন, আইনস্টাইন তার শিক্ষক ম্যাক্স ট্যালমুডির অনুপ্রেরণায় বিজ্ঞানের পথে যাত্রা শুরু করেন, বা গান্ধী তার গুরু গোপালকৃষ্ণ গোখলের আদর্শ অনুসরণ করে অহিংস আন্দোলন চালান।

কেন আমরা তাদের পথ অনুসরণ করব?

প্রিয়জনদের পথ অনুসরণ মানে কখনোই অন্ধ আনুগত্য নয়। বরং এটি হলো তাদের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা থেকে শেখা, তাদের আদর্শকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা।

• একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান যদি তার বাবার স্বাধীনতার চেতনা ধারণ করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়, তাহলে সেটিই হয় তার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা।

• যদি কোনো বাবা তার সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখেন, তবে সন্তানের উচিত সেই স্বপ্ন পূরণ করা।

কীভাবে সেই পথে চলা সম্ভব?

প্রিয়জনের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন – তাদের সংগ্রাম, সিদ্ধান্ত ও অভিজ্ঞতা থেকে শিখুন।

মূল্যবোধ অটুট রাখুন – সততা, ন্যায়বিচার ও মানবতার পক্ষে দাঁড়ান।

তাদের অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করুন – তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করুন।

স্মৃতিকে শক্তিতে রূপান্তর করুন – দুঃখে ভেঙে না পড়ে তাদের স্মৃতি থেকে অনুপ্রেরণা নিন।

শেষ কথা

প্রিয়জনদের দেখানো পথ কখনোই হারিয়ে যায় না, যদি আমরা সেই পথে চলতে থাকি। তারা হয়তো আমাদের পাশ থেকে সরে গেছেন, কিন্তু তাদের জীবনদর্শন আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকে। তাই, আসুন আমরা সততার, ন্যায়ের ও ভালোবাসার পথে চলি—সেই পথে, যে পথে আমাদের প্রিয়জনরা গেছেন। তাহলেই তাদের স্মৃতি কেবল স্মৃতি হয়ে থাকবে না বরং আমাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠবে।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন) [email protected]

এমআরএম/এমএস



Source link

Exit mobile version