আজও শুকায়নি বন্যার ক্ষত, পুঁজি হারিয়ে দিশাহারা মাছচাষিরা

• বন্যায় ক্ষতি হয়েছে ৭০০ কোটি টাকা
• বন্যার পানিতে ভেসে গেছে ১৯ হাজার টন মাছ
• ২ হাজার একরে ২০ লাখ কেজি মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার শত শত মৎস্যচাষি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। পুঁজি হারিয়ে তারা দিশাহারা। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে বন্যা কবলিত হওয়ার সাত মাস পার হয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত সরকারি কোনো সহযোগিতা পাননি তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরসরাইয়ে গত বছরের আগস্ট মাসের ভয়াবহ বন্যায় মৎস্য খাতে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। কিন্তু ওই ক্ষতি পুষিয়ে এখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি তারা। তাই অনেক মৎস্য চাষি ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। একদিকে বন্যায় ক্ষতি, অন্যদিকে ব্যাংকের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন মাছচাষিরা। এমন বিপদে ব্যাংক সুদের টাকা মওকুফ না করায় মৎস্য চাষিরা আরও বেশি সমস্যায় পড়েছেন।
মিরসরাই উপজেলার ওসমানপুর ইউনিয়নের মরগাং এলাকার মৎস্যচাষি মো. সেলিম। ২০০৭ সালে ব্যাংকে সাড়ে ৬ একর জমি জামানত দিয়ে ৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন। শুরুতে ৩ একর প্রকল্প থাকলেও গত আগস্টের বন্যার আগে তার প্রকল্প গিয়ে ঠেকে ১১টিতে। ১৮০ একরের ১১টি মৎস্য প্রকল্পে প্রায় ৩০ কোটি টাকার বিক্রয়যোগ্য রুই, কাতল, তেলাপিয়া, পাঙ্গাস, শিং, কালবাউসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছিল। কিন্তু বন্যায় ১২৫ একর প্রকল্পের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। এতে তার ক্ষতি হয়েছে ২৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন-
সেলিম উদ্দিন বলেন, মিরসরাইয়ের মুহুরী প্রজেক্টসহ এর আশপাশের এলাকায় শত শত মৎস্যচাষি রয়েছেন। মাছচাষের ওপর নির্ভর করে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এই এলাকায়। আমার প্রকল্পে দিনে ও রাতে স্থায়ীভাবে কাজ করে ৪০ জন। যাদের প্রত্যেকের মাসিক বেতন ২০ হাজার টাকা। এছাড়া মাছ বিক্রি ও পরিবহনের সময় প্রায় ২০০ মানুষ কাজ করে। ভেবেছিলাম এমন বিপদে সরকার ও ব্যাংক আমাদের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু কিছুই পেলাম না। নতুন করে ব্যক্তি ঋণ নিয়ে প্রকল্পগুলো সংস্কার করেছি। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা না করে কিছুতেই ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। বর্তমানে আমার ১১টি মৎস্য প্রকল্পে দৈনিক ১০ টন খাদ্য দিতে হয়। যার মূল্য সাড়ে ৭ লাখ টাকা। আমি অর্থের অভাবে খাবারের যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছি। বেতন দিতে পারছি না কর্মচারীদের।
ফারহা অ্যাগ্রোর স্বত্ত্বাধিকারী মো. কামরুল হোসেন বলেন, প্রায় ২২ বছর ধরে মাছচাষ করে আসছি। কখনো এত বড় লোকসানের মুখে পড়তে হয়নি। আমার প্রায় ২০ কোটি টাকার মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। আমার ভাই কাউছার হোসেনের প্রায় ৭ কোটি, আরেক ভাই জারা অ্যাগ্রোর মালিক আব্দুল্লাহ আল মামুনের ৫ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। আমাদের পরিবারের ক্ষতি হয়েছে ৩২ কোটি টাকা। এভাবে শত শত মৎস্যচাষি ক্ষতির সম্মুক্ষীণ হয়েছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সরকারি কোনো সহযোগিতা পাইনি।
ধুম ইউনিয়নের মৎস্যচাষি আলী হায়দার টিপু বলেন, আমার জীবনের সব সঞ্চয় শেষ। গেলো বছরের বন্যায় আমার ১০ কোটি টাকার বেশি মাছ ভেসে গেছে। পানি কমে যাওয়ার পর প্রকল্পে গিয়ে দু’চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কীভাবে নতুন করে ব্যবসা শুরু করবো বুঝতে পারছি না।
উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, মিরসরাইয়ে ৭ হাজার হেক্টর ছোট বড় মৎস্য খামার রয়েছে। এসব খামারে বছরে প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়। এসব মাছ নিজ উপজেলার চাহিদা মিঠিয়ে চট্টগ্রামের ৭০ শতাংশ মাছের চাহিদা পূরণ করে। কিন্তু গত বছরের আগস্ট মাসের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় চট্টগ্রামের মৎস্য জোন খ্যাত মিরসরাইয়ের মুহুরী প্রজেক্টে ব্যাপক ক্ষতি হয়। বন্যার পানিতে ২ হাজার ২৯ হেক্টর আয়তনের খামারের ১৯ হাজার ২০ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে বন্যার পানিতে ভেসে গেছে ৪৬ লাখ ৪০ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা।
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরিফুর রহমান বলেন, মিরসরাইয়ে সাম্প্রতিক বন্যায় মৎস্য খাতে আমাদের উপজেলায় বেশি ক্ষতি হয়েছে। কিছু প্রান্তিক চাষিকে পোনা দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বলেন, চট্টগ্রাম জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিদের প্রায় ৪৯ লাখ টাকার পোনা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আমরা সব সময় ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিদের পাশে রয়েছি।
এম মাঈন উদ্দিন/এফএ/এমএস